মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন তিনি। দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এডিস মশার জীবনচক্র। তিনি কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও দেশের প্রথম কীটতত্ত্ব গবেষণাগার আইআরইএসের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। তাঁর কাছ থেকে এডিস মশার জীবনচক্র ও বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের উপায় জেনেছেন কালের কণ্ঠের আদীব আরিফ, সৌজন্যে নিউজ৩৯।
প্রাণিজগতের অর্ধেকের বেশিই বিভিন্ন ধরনের পোকা-মাকড়। মজার ব্যাপার, এগুলোর ৯৯ শতাংশই উপকারী। যে এক শতাংশ অপকারী পোকা-মাকড় রয়েছে সেগুলো নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে। সেগুলোকে জানার ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও চলছে। অন্যদিকে মৌমাছি, রেশম পোকার মতো উপকারী পোকা-মাকড় চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হচ্ছে অনেক দেশ। তবে সেই এক শতাংশ অপকারী পোকা-মাকড়ের একটি এডিস মশা আমাদের দেশে হয়ে উঠেছে এক আতঙ্কের নাম। ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী রহস্যময় ও ‘অভিজাত’ এই মশা নিয়ন্ত্রণ, ডেঙ্গুর লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার নিয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। দীর্ঘদিন ধরে এডিস মশার জীবনচক্র নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। জানালেন, ‘ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গুর দেখা মেলে ১৯৬৪ সালে। তখন এই অসুখের নাম ছিল ঢাকা ফিভার। ২০০০ সালে এটির মাত্রা ব্যাপক বেড়ে যায়। তারপর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তবে এ বছর এর মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এডিস এলবোপিকটাস ও এডিস ইজিপটাই—দুই ধরনের এডিস মশাই ডেঙ্গুর কারণ। তবে এর মধ্যে প্রথম প্রজাতিটিই প্রধান বাহক। ৯৫ শতাংশ ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে এটি।’
এডিস মশার ডিম
ড. বাশার জানালেন, দেশে থাকা মশার ১২৩টি প্রজাতির মধ্যে ঢাকায় আছে ১২টি। এর মধ্যে এখানে এডিস ও কিউলেক্স বেশি প্রভাবশালী। এডিস মশার ডিম ছয় মাস পর্যন্ত শুকনো অবস্থায় ভালো থাকে। এবার ডেঙ্গুর এমন প্রাদুর্ভাবের অন্যতম কারণ, ১৯৫৩ সালের পর এ বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে এত বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তাই পানি পেয়ে শুকনো ডিমগুলো এবার আগেভাগেই বংশবিস্তার করেছে। তাই শুধু কোনো নির্দিষ্ট সময়ই নয়, সারা বছরই চারপাশ পরিষ্কার রাখা, ঘরের কোথাও পানি জমতে না দেওয়া দরকার।
লার্ভা
তিনি আরো জানালেন, মশার জীবনচক্র চারটি ধাপে বা দশায় বিভক্ত—ডিম, ডিম ফুটে লার্ভা, লার্ভার পিউপায় রূপান্তর এবং পিউপা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক মশা। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন চারটি টুলস—পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জৈবিক ব্যবস্থাপনা, রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (ওষুধ দেওয়া) এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করা। ড. বাশার বলেন, ‘এই চারটি কাজের মধ্যে সিটি করপোরেশন করে মূলত তৃতীয়টি। তবে এডিস মশাকে টার্গেট করে কোনো কীটনাশক বা ওষুধ তৈরি হয় না। এটি বরং অন্য মশাগুলোর চেয়ে দুর্বল। পেটে ডিম এলেই শুধু রক্ত খায়। ২১ দিনের আয়ুষ্কালে একটি এডিস মশা চার থেকে পাঁচজনের রক্ত খেতে ও তাদের শরীরে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। যে ওষুধে কিউলেক্স মশা মরবে, সেই ওষুধে এডিস মশা মরবেই। তবু নতুন কীটনাশক কেনার আগে ঠিকমতো পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত।’
পিউপা
ড. বাশার যেখানে গবেষণা করেন, দেশের প্রথম কীটতত্ত্ব গবেষণাগার হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ইনসেক্ট রিয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশনের (আইআরইএসের) যাত্রা শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০, তাঁর ও নিজ বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার হাওলাদারের হাত ধরে। এটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা ড. বাশার জানালেন, সম্প্রতি ফড়িঙের নিম্ফ দিয়ে মশার শূককীট নিয়ন্ত্রণের একটি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এখানে। ফড়িঙের নিম্ফ ও মশার শূককীট উভয়ই পানিতে থাকে। তাই ফড়িঙের নিম্ফ দিয়ে বায়োলজিক্যালি মশার শূককীট নিয়ন্ত্রণ খুব ফলপ্রসূ। এই পদ্ধতি ব্যবহারে মশা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। এ ছাড়া এরই মধ্যে এক ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে পূর্ণবয়স্ক মশা নিয়ন্ত্রণের একটি গবেষণা শেষ হয়েছে। কেমিক্যালটির মিশ্রণ যদি রঙের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ালে রং করা হয়, এক বছর ঘরটি মশামুক্ত থাকবে। মশা নিয়ন্ত্রণের আরো কিছু গবেষণা এখন চলছে গবেষণাগারটিতে। এটি ২৪ ঘণ্টাই খোলা। এখানে ড. বাশারের সঙ্গে কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের অর্ধশত শিক্ষার্থী।
মন্তব্য