‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’। মানুষের জীবন-জীবিকা, বাসস্থান, পরিবেশ সবকিছুকে তুচ্ছ মনে করে দোহার-নবাবগঞ্জর পদ্মা ও ইছামতি নদীসহ ছোট ছোট খাল বা শাখা নদী এমনকি ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ফসলি জমিকে পুঁজি করে ক্ষমতার এই হুলি খেলায় মেতে উঠেছে বালু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। বালু ব্যবসায়ী হলেও, স্থানীয়ভাবে আড়ালে-আবডালে মানুষ এদের বলে ‘বালুদস্যু’। তাদের উত্থানে দুই উপজেলার নদী ও তীর এমনকি সড়কগুলোও কম্পিত। এ কাঁপনে সবচেয়ে বেশি কাঁপছে সাধারণ মানুষ।
বালুর ট্রাক ও ড্রেজারের পাইপের সর্বনাশা থাবায় গত এক মাসে ঝড়েছে ৭টি তাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হয়ে পুঙ্গত্বকে বরণ করেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ কিছুটা সুস্থ হলেও শরীরে রয়ে গেছে ক্ষত। কোন কিছুরই পরোয়া করছে না এ সিন্ডিকেট। আর সব জেনেও নিশ্চুপ রয়েছে প্রশাসন। জানা যায়, গত এক সপ্তাহে বালুর ট্রাকের চাপায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয়েছে দুই স্কুলশিক্ষার্থী। এরা হলো দোহার উপজেলায় মালিকান্দা গ্রিনলিফ প্রিপারেটরি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী বাহালুল ও দোহারের ইসলামাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সাফিয়া আক্তার। এছাড়া আহত হয়েছে বাহালুরের বাবা খোকন বেপারি ও বড় বোন খুশবু।
আর নবাবগঞ্জে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে রাস্তার ওপর ড্রেজারের পাইপের ধাক্কায় মারা গেছেন ৫ জন। এরা হলেন সাপ্তাহিক সময়ের সঙ্গে পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সাজিদ আহমেদ রিপন, নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক নাজমূল, মহব্বতপুর গ্রামের আমিন, কলাকোপার এলাকার মনির হোসেন।
এছাড়া গত সপ্তাহে ড্রেজারের পাইপের কবলে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাজধানীর জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন দোহারের রাইপাড়া এলাকার আরব আলীর ছেলে মো. সবুজ (২৫)। একই সঙ্গে আহত হয়েছে রিয়াজুল নামে অপর এক যুবক।
সরজিমন দেখা যায়, সুন্দরীপাড়া এলাকার প্রধান রাস্তায় দুটি, মালিকান্দা এলাকার প্রধান রাস্তায় একটিসহ নারিশা ও অলিগলির বিভিন্ন রাস্তায় স্থাপন করা হয়েছে প্রাণঘাতী এসব পাইপ। এছাড়া নবাবগঞ্জের কোমরগঞ্জের প্রধান সড়কে দুটি, বাগামারা এলাকার প্রধান সড়কে দুটি ও সাদাপুর এলাকার প্রধান সড়কে পারাপার করে উচ্চতাসম্পন্ন ড্রেজার পাইপ স্থাপন করে ব্যক্তিগত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বালুদস্যুরা। কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ওপর স্থাপন করা হচ্ছে এসব ড্রেজার পাইপ। আবার নদীর পাড় থেকে বালু বহন করা হচ্ছে ফিটনেসবিহীন ট্রাক ও মাহেন্দ্রার মাধ্যমে। যেগুলোর স্টিয়ারিং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও অদক্ষ চালকের হাতে। নবাবগঞ্জের কোমরগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, সড়কের ওপর ড্রেজারের বালুর পাইপ স্থাপনের কারণে যানবাহন চলাচলে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় এসব পাইপের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিভিন্ন যানবাহন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
এসব যানবাহনের যাত্রী ও চালকরা হতাহত হন। রাতে দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বেশি। তারা বলেন, ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন ও ব্যবসার সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। বেশির ভাগ ড্রেজারই সরকারের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে চালানো হয়। স্থানীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর সঙ্গে জড়িত থাকায় কেউ কিছু বলতেও পারেন না। নবাবগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে দ্রুত অপসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যারা অবৈধ বালুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।