নিয়ন্ত্রণহীন স্বর্ণের বাজার, ঠকছেন ক্রেতা-বিক্রেতা

55
নিয়ন্ত্রণহীন স্বর্ণের বাজার, ঠকছেন ক্রেতা-বিক্রেতা

ভালো মানের (২২ ক্যারেট) প্রতি ভরি স্বর্ণের বর্তমান দাম ১ লাখ ৭৭৭ টাকা। ২০০৯ সালে দেশের বাজারে একই মানের স্বর্ণ পাওয়া যেত ২৬ হাজার ৩৫১ টাকায়। গত ১৪ বছরে আমদানিকৃত মূল্যবান ধাতুটির দাম বেড়েছে প্রায় চার গুণ। দীর্ঘদিন ধাপে ধাপে বাড়লেও গত দু’বছর স্বর্ণের বাজারে বিরাজ করছে ব্যাপক অস্থিরতা। এর মধ্যে গত ১৮ মার্চ এক লাফে ভরিতে ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বেড়ে রেকর্ড গড়ে। দেশে বেশির ভাগ আমদানি পণ্যের মুনাফার মোটামুটি হার নির্ধারিত এবং সেভাবেই দর ধরা হয়। স্বর্ণই একমাত্র ‘বলগাহীন পণ্য’, যার দাম নির্ধারণে ব্যবসায়ীরা কোনো নিয়মের ধার ধারেন না।

দেশে অস্বাভাবিক দামের কারণে শুধু মধ্যবিত্ত নয়, উচ্চ মধ্যবিত্ত অনেকেই এখন বিয়েসহ বিভিন্ন উপলক্ষে স্বর্ণের অলংকার কেনা বাদ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ঠিক কী পদ্ধতিতে দেশে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে সাধারণত স্বর্ণের দাম বাড়ে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বর্ণের দাম এত বেশি হওয়ার কথা নয়। নিয়মের মধ্যে দাম নির্ধারণ ও কার্যকরী আমদানি নীতিমালা হলে অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর প্রবণতা কমবে। শুল্কহার পুনর্বিবেচনা ও আমদানির জন্য বিকল্প উৎস খোঁজার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে নির্দিষ্ট হার যুক্ত করে দেশে স্বর্ণের দর নির্ধারণ করা যেতে পারে।

দ্রুত নীতিমালার অধীনে না আনলে স্বর্ণের বাজার মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

দামের রকমফের ও বাজুস

দেশে স্বর্ণের দাম কত হবে, তা নির্ধারণ করে বাজুস। সংগঠনটি বলছে, স্বর্ণসহ মূল্যবান ধাতু সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কিটকো ডটকমের দরের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে দাম বাড়ানো বা কমানো হয়। তবে বাস্তবে দুটি দরে ফারাক থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট গোল্ডপ্রাইসের তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে ৪ আগস্ট প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ১৯৩২ দশমিক ৯০ ডলার। এটি ২০২০ সালের চেয়ে ১৩৭ ডলার কম। এ হিসাবে বাংলাদেশে এখন স্বর্ণের দাম কম থাকার কথা। ২০২০ সালের আগস্টের শুরুর দিকে করোনাকালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে এবং প্রতি আউন্স (৩১.১০৩ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এটিই ইতিহাসের সর্বোচ্চ দর। বিশ্ববাজারের ঊর্ধ্বমুখী ওই দরের সময়ও বাংলাদেশে স্বর্ণের ভরি ছিল ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। এর সঙ্গে গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে নতুন করে ঝুঁকিতে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। দেশে দেশে হয় মূল্যস্ফীতির রেকর্ড। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে স্বর্ণের দাম। তবে এখনও তা ২০২০ সালের দর স্পর্শ করেনি।

অন্য খবর  নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পোশাক কারখানায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৮ ইউনিট

আবার প্রতিবেশী ভারতের দি ইকোনমিক টাইমসের তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার দেশটিতে প্রতি ভরি স্বর্ণ ৬৫ হাজার ৭৮৫ রুপি, যা টাকায় ৮৬ হাজার ৮৩৬ ছিল। জানতে চাইলে বাজুসের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘ভারতে কেন কম, তা তাদের ব্যবসায়ীরা বলতে পারবেন। আমরা বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে সমন্বয় করি।’

অস্বাভাবিক দর বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্ন রেখে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা সমকালকে বলেন, ‘ধান উৎপাদনের শতভাগ সক্ষমতা সত্ত্বেও পাঁচ বছরে চালে ৩০ টাকা, দ্বিগুণ দামে আটা, ১০০ টাকার সয়াবিন তেল কেন ২০০ টাকা হয়েছে? ডলারের দর না কমলে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান ছাড়া দাম কমবে না। সত্যি সত্যি চীনও যুদ্ধে জড়ালে ভরি দেড় লাখে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।’ নীতিমালার বিষয়ে ব্যবসায়ীরাও ইতিবাচক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার থেকে সিদ্ধান্ত এলে অবশ্যই ব্যবসায়ীরা মেনে নেবেন। তবে দাম তো সরকারই বাড়িয়ে দেয়। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ছাড়াও সরকারের শুল্ক বৃদ্ধির কারণেই বেড়ে যায় দাম।’

অবশ্য দাম বাড়াকে ব্যবসায়ীদের কৌশল মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা। তিনি সমকালকে বলেন, সপ্তাহ কিংবা মাস পরপর দাম সমন্বয় করা যাবে, এমন আইন দরকার। পাশাপাশি এ সমন্বয় বিশ্ববাজারের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্য, তা নজরদারি করতে হবে। ব্যাগেজ রুলে সংস্কার ও শুল্ক আরোপের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট দেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আমদানির জন্য বিকল্প উৎস খোঁজা উচিত।

অন্য খবর  বান্দরবানে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সাঙ্গুর পানি

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বিশ্ববাজারে প্রতিদিন স্বর্ণের দাম ওঠানামা করে। এ জন্য প্রতি সপ্তাহ বা মাসে গড় দাম বের করা সম্ভব। ওই দামের সঙ্গে কিছু মার্জিন যেমন ৫, ৭ বা ৮ শতাংশ কিংবা এমন যা-ই হোক যুক্ত করে দাম ধরা যেতে পারে। এ জন্য নীতিমালা করতে হবে। সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে খাতটি মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং একচেটিয়া দাম নির্ধারণে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা।’

কেনা-বিক্রিতে ঠকেন ভোক্তা

দেশে জুয়েলারি সমিতির যে নিয়ম, তাতে স্বর্ণের অলংকার কেনা ও বিক্রি– উভয় ক্ষেত্রে ঠকেন ভোক্তা। বিপরীতে দুই ক্ষেত্রেই লাভবান হন ব্যবসায়ী। বাজুসের অলংকার ক্রয়-বিক্রয় ও বিপণন নির্দেশিকা-২০২৩ অনুযায়ী, স্বর্ণের অলংকারের ওজন থেকে ২০ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। অলংকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও ওজন থেকে ১০ শতাংশ বাদ দেওয়া হয়। আগে এটি ১৫ ও ৮ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে স্বর্ণের অলংকার বিক্রির সময় ক্রেতার কাছ থেকে প্রতি গ্রামে কমপক্ষে ৩০০ (ভরিতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টাকা) টাকা মজুরি নেওয়া হয়।

আবার নিয়ম অনুযায়ী, অর্ডার করা অংলকার প্রস্তুত বা বুকিং দেওয়া অলংকার সরবরাহের ক্ষেত্রে অর্ডার বা বুকিংয়ের দিনে বাজার মূল্য কার্যকর হবে। অর্ডার গ্রহণের সময় সর্বোচ্চ এক মাস, এর পর অর্ডার বাতিল হবে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা যে বায়না বা অগ্রিম টাকা বা স্বর্ণ দিয়েছেন, তা থেকে ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে বাকি টাকা বা স্বর্ণ ওই ক্রেতাকে ফেরত দেওয়া হবে। সমিতির নিয়মের মারপ্যাঁচে ঠকছেন ক্রেতারা।

স্বর্ণ নীতিমালা ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পুরোনো অলংকার গলিয়ে মেটে, বাকিটা আসে বিদেশ থেকে। এদিকে, দেশে কতগুলো জুয়েলার্স আছে, তার সঠিক হিসাব নেই। জুয়েলার্স সমিতির তথ্য মতে, ঢাকায় তাদের সদস্য ৭৫০, সারাদেশে প্রায় ৪০ হাজার।

 

আপনার মতামত দিন