দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ: অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও জাতীয়করণবঞ্চিত

2257

‘হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে/কাজ করে যাও গোপনে গোপনে’- কবিগুরু রবি ঠাকুরের এ চয়ন দুটি যেমন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নীরবে নিভৃতে ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমায় অগ্রগামী করে তেমনি এক লড়াই-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে অর্ধশতাব্দী পার করেছে দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ। কিন্তু আজও ঐতিহ্যবাহী এ কলেজ জাতীয়করণের মুখ দেখেনি।
জানা গেছে, ’৬৯’এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সব গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে এ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা কখনোই পিছপা হননি। ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তের জনগোষ্ঠীর জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র এটি। আলোকিত করছে এ অঞ্চলের মানুষকে। এতকিছুর পরও অবহেলা আর অপেক্ষার দিন গুনে এগিয়ে চলেছে প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটি।
সারা দেশের অনেক কলেজ সরকারিকরণ হলেও কেন উপেক্ষিত দোহার-নবাবগঞ্জ (ডিএন) কলেজ- এমন প্রশ্ন সবার। কিছু দিন ধরে কলেজটি সরকারিকরণের দাবিতে ফুঁসে ওঠেন এ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকসহ এলাকার আমজনতা। তাদের একটাই দাবি- যে করেই হোক কলেজটিকে সরকারিকরণ করতে হবে।
সমসাবাদ এলাকার বাসিন্দা আবদুল জলিল বলেন, ঢাকা জেলার দোহার-নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও ধামরাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ। এটি সরকারি না হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। লেখাপড়ার মান, সংস্কৃতি ও ফলাফলের দিক থেকেও এ কলেজটি অনেকগুণ এগিয়ে।
দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মানবেন্দ্র দত্ত বলেন, এ বছরও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২৫ জন জিপিএ-৫-সহ ৭৫.১৪ ভাগ পাস করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, কলেজটি সরকারিকরণে দ্রুত পদক্ষেপ নিন। যাতে এ অঞ্চলের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সন্তানরা সহজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন জানান, কলেজে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ছাত্রছাত্রী, ৫৬ জন শিক্ষক ও ১৯ জন কর্মচারী রয়েছেন। নিজ এলাকায় কলেজ থাকা সত্ত্বেও দোহার, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, সিরাজদিখান, মানিকগঞ্জের সিংগাইর, হরিরামপুর ও ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার অনেক ছাত্রছাত্রী এ কলেজে পড়াশোনা করছে। কারণ একটাই- ভালো ফল। প্রতিটি মুহূর্তেই তারা সরকারিকরণের আশায় দিন গুনছে।
জানা যায়, এ কলেজের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ১০০ জনের একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। শিক্ষক আবাসিক আছে একটি। যেখানে মাত্র ১৪ জন শিক্ষক থাকতে পারেন।
জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনী জনসভায় পাইলট স্কুল মাঠে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজকে সরকারিকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওয়াদা করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। তারপরও কলেজটি সরকারিকরণের প্রকাশিত তালিকায় না থাকায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ নবাবগঞ্জের মানুষ।
দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ একটি নাম, একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যার জম্ম হয়েছিল পদ্মা নদী বিধৌত দোহার-নবাবগঞ্জের ইছামতী নদীর তীরে সমসাবাদ নামক স্থানে। এর চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জনবসতি। এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর দোহারের আশরাফ আলী ওরফে মধু চৌধুরী, নবাবগঞ্জের সেলিম চৌধুরী, খন্দকার আলী আব্বাস, চাষী বাহার, মানবেন্দ্র দত্তসহ তৎকালীন কিছু উদ্যমী তরুণ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৬৫ সালে দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের সূচনা হয়। নবাবগঞ্জের গালিমপুরের বাসিন্দা, সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত আতাউদ্দিন খানের মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে কলেজটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্ধশত বছর পার করেছে ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ নবাবগঞ্জ উপজেলার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ। কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কলেজ ক্যাম্পাসের বৃহদাকার বটবৃক্ষটি। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে কলেজটি তার নিজস্ব বলয়ে যশ, খ্যাতি আর সুনাম বয়ে এনেছে। এ কলেজে জ্ঞানার্জন করেছেন দেশ-বিদেশে অবস্থান করা অনেক ক্ষণজন্মা।
নবাবগঞ্জের বাসিন্দা ও কলেজ নির্মাণের প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল আলীম বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে নবাবগঞ্জে এক জনসভায় দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজকে সরকারিকরণের কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হলেও দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজকে জাতীয়করণ করুন।

আপনার মতামত দিন