আর্সেনিক পরীক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের আশায় বিজ্ঞানীরা

970

রিয়াজুল ইসলাম ♦ বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন, যদি তাতে আর্সেনিক না থাকে৷ বাংলাদেশের বহু মানুষ এই বিষে আক্রান্ত৷ জটিল ও ব্যয়বহুল হওয়ায় আর্সেনিক পরীক্ষাও করাতে পারছেন না অনেকে৷ তবে জার্মান বিজ্ঞানীদের নতুন এক পরীক্ষা আশার আলো নিয়ে এনেছে৷

আর্সেনিক

ছবি: সাধারণ মানুষ আর্সেনিকের অস্তিত্ব টের পায় না

নীরব ঘাতক

বাংলাদেশের সবগুলো গ্রামেই সকাল বেলা দেখা যায় এই ধরণের দৃশ্য৷ টিউবওয়েল থেকে পানি নেওয়ার জন্য কলতলায় ভীড় করেছে গ্রামের মেয়েরা এবং শিশুরা৷ শহরাঞ্চলের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও এই টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভরশীল৷ স্বাধীনতার পর জাতিসংঘের উদ্যোগে গোটা দেশে বিশুদ্ধ পানির জন্য এই টিউবওয়েল বসানোর উদ্যোগ শুরু হয়৷ কিন্তু বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে সঙ্গে এক নীরব ঘাতকও চলে এসেছে এই টিউবওয়েলের মধ্য দিয়ে৷ তার নাম আর্সেনিক৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ এই আর্সেনিকের ছোবলে আক্রান্ত৷ কেবল বাংলাদেশ নয় আরও অনেক জায়গাতেও ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে আর্সেনিকে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ৷ কিন্তু বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি গোটা বিশ্বের মধ্যে ভয়াবহতম৷

পরীক্ষায় জটিলতা

আর্সেনিক খালি চোখে দেখা যায় না, এর কোন রং নেই এমনকি নেই কোন স্বাদ কিংবা গন্ধ৷ তাই সাধারণ মানুষ এর অস্তিত্ব টের পায় না৷ আর শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার লক্ষণ আসতেও ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগে৷ বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানও ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার অন্যতম কারণ৷ সাধারণ যে রাসায়নিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক ধরা যায়, সেটা বেশ ব্যয়বহুল৷ তাই সহজ এবং কম খরচে আর্সেনিক পরীক্ষার উপায় বের করাটা খুবই প্রয়োজনীয়৷

অন্য খবর  সকল সরকারি সেবা ৩৩৩ উদ্বোধন

আর এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে জার্মানির লাইপজিগে অবস্থিত হেল্মহোল্টজ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ৷ এখানকার বিজ্ঞানী হাউকে হার্মস এক নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি বের করেছেন যার মাধ্যমে সহজেই পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়া সম্ভব৷ সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বে জার্মান একদল বিজ্ঞানী বাংলাদেশ সফর করেন৷ ঢাকা থেকে অদূরে তারা যান একটি গ্রামে, এবং সেখানকার টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে দেখেন৷

নতুন পদ্ধতি

সাধারণত পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরার জন্য কেমিকেল টেস্ট বা রাসায়নিক পরীক্ষা চালানো হয়৷ কিন্তু অনুজীব বিজ্ঞানী হাইকে হার্মস তার পরিবর্তে বায়োসেন্সর পদ্ধতি ব্যবহার করছেন ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরার জন্য৷ তিনি মনে করছেন বায়োডিটেকটিভ পদ্ধতি ব্যবহার করে কেমিকেল টেস্টের চেয়ে দ্রুত এবং সহজে আর্সেনিক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরা সম্ভব৷ নতুন এই পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে হাইকে হার্মস বললেন, ‘‘যখন আমরা ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করি, তখন সেগুলো বেশ সতেজ থাকে৷ সেগুলোকে শুকানো হয়না এবং বরফে জমিয়েও রাখা হয় না৷ এগুলোর একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ আমার কাজ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়ার এই প্রতিক্রিয়াগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা এবং দ্রুত সমস্যার সমাধান বের করা৷ এবং এই সমাধান হতে হবে গবেষণাগারে পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত সমাধানের কাছাকাছি৷’

অন্য খবর  ৩০ বাংলাদেশি বিজ্ঞানী চালাবেন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

আর্সেনিক

ছবি: বাংলাদেশের সবগুলো গ্রামেই সকাল বেলা দেখা যায় এই ধরণের দৃশ্য

ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার

আর্সেনিক পরীক্ষার বেলায় জার্মান বিজ্ঞানীরা এক ধরণের বিশেষ ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করেন যা আর্সেনিকের সংস্পর্শে আসা মাত্র জ্বলে ওঠে৷ এই সব ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে রয়েছে লুমিনাস রিপোর্টার প্রোটিন যা আর্সেনিকের বেলায় খুবই সংবেদনশীল৷ বিজ্ঞানী হাইকে হার্মসের মতে, পরিবেশের মধ্যে যে কোন ধরণের পরিবর্তন হলে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও তার প্রভাব পড়ে৷ ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের নড়াচড়ার মধ্য দিয়ে সেই পরিবর্তনের খবর জানিয়ে দেয়৷ তাই ব্যাকটেরিয়াকে যদি আরো সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং তাদের এই প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তনগুলোকে চিহ্নিত করা যায় তাহলে সেটি অন্যান্য সাধারণ রাসায়নিক পরীক্ষার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে৷ পানিতে আর্সেনিক পরীক্ষার বেলাতে তিনি তার এই ধারণা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন৷ বিজ্ঞানী হার্মসের আশা, অদূর ভবিষ্যতে এই বায়োটেকনিক হবে সবচেয়ে আধুনিক এবং কার্যকর পরীক্ষা পদ্ধতি৷

এই মুহূর্তে এই পদ্ধতিটি নিয়ে আরও গবেষণা করে যাচ্ছেন হাইকে হার্মস৷ তবে অদূর ভবিষ্যতে এটি প্রেগনেন্সি টেস্টের মতই অত্যন্ত সহজ এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে৷ ফলে গ্রামের মানুষকে আর আর্সেনিক পরীক্ষার জন্য অন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হবে না৷

আপনার মতামত দিন