কৌশল প্রয়োগ করলেই চেনা যাবে ফেক নিউজআসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অনলাইনে অপপ্রচার বা অপরাধ বাড়ার শঙ্কা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। অনলাইনের কোন বিষয়টি সঠিক আর কোনটি বেঠিক, কোনটি শুদ্ধ, কোনটি ভুল বা ভুয়া তা জানতে না পারলে সেই নিউজ অনেক ধরনের সমষ্যা তৈরি করতে পারে। সামান্য ট্যাপ, ক্লিক কিংবা শেয়ারিং-এর মাধ্যমে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। সেই ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে অনলাইনের ভুয়া বা গুজব চেনার কয়েকটি সহজ উপায় তুলে ধরা হলো।
কীভাবে ছড়ায়?
ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ায় বাতাসের বেগে। তবে এর উৎসমূলটিও থাকে বাতাসের মতো অধরা কিংবা নড়বড়ে। কাণ্ডজ্ঞান হীনতা, অতি আবেগ কিংবা অজ্ঞতাকে পুঁজি করে অনলাইনে বিস্তার ঘটে ভুয়া কিংবা গুজবের। সাইর্চ ইঞ্জিন, ওয়েব সাইট কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে এসব খবর বা গুজব হ্যামিলিয়নের বাঁশি ওয়ালার মতোই আকর্ষণ করে ডিজিটাল সিটিজেনদের। ভুয়া বা গুজব ছড়ায় মূলত নকল ওয়েব সাইট, সোশ্যাল মিডিয়ার নকল প্রোফাইল থেকে। একইভাবে ছড়ায় অপরিচিত, অবিশ্বস্ত লিংক থেকে। তাই আসল বা নকল চিনতে না পারলে ভুয়া বা গুজবের খপ্পরে পড়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
যেভাবে চিনবেন বাহকটি ভুয়া বা গুজব: ভুয়া তথ্য বা গুজব সবসময়ই একটু থ্রিলধর্মী হয়। শব্দে-ছবিতে থাকে চমক। বেশ সম্মোহনী হয়ে থাকে। তাই এই খবর বা ছবি কোথা থেকে প্রচার হচ্ছে তা দেখে নেওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ। কেননা এসব খবর বা ছবি কেবল বিভ্রান্তই করে না, বিপদও ডেকে আনে। গুজব বা ভুয়া খবর আসলে একটি বড়শির মতো, যার অগ্রভাগে গাঁথা থাকে মুখোরচক খাবার। অর্থাৎ খাবারটা গ্রহণ করা মানেই বড়শির টোপ গিলে ফেলা।
তাই অনলাইন জীবনে ওয়েব সাইট ভিজিট বা পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে যেসব ওয়েব ঠিকানায় http এর পরে ‘s’ থাকে না সেগুলো সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া মূল ওয়েবসাইটের ডোমেইন নামের বানান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নামের বানান এদিক ওদিক করে হর নকল ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়। তাই একটু কষ্ট করে https://whois.icann.org/en এই ঠিকানায় গিয়ে ওয়েবসাইটটি কবে তৈরি হয়েছে, কে তৈরি করেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গুজব/ভুয়া তথ্য-উপাত্ত চেনাটা বেশি কঠিন। এক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের শিরোনামে বিভ্রান্ত হওয়ার চেয়ে এর উৎসটি যাচাই করা মঙ্গল। ফেসবুকের ক্ষেত্রে ভেরিফায়েড পেজ ছাড়াও প্রোফাইলের ছবি বা নেচারও গুরুত্বপূর্ণ। একটু বুদ্ধি খাটালেই নকল প্রোফাইলের ফাঁদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে কেউ যদি কোনও বিষয় নিয়ে দ্বিধান্বিত হন তখন ফেসবুকে ফ্যাক্ট চেকার গ্রুপ https://www.facebook.com/bdfactcheck থেকে অথবা ওয়েবসাইট থেকে https://bdfactcheck.com কিংবা https://www.jaachai.com -এর সাহায্য নিতে পারেন। তবে নিজেই যদি আসল-নকল, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ভুয়া চিহ্নিত করতে চান তা-ও সম্ভব। আবার https://twitter.com/StopFakingNews থেকে টুইটারে ছড়িয়ে পাড়া ভুয়া খবর, নকল বা মিথ্যা তথ্য সম্পর্কে অজানা যায়। এক্ষেত্রে অনলাইনে ছবি ও লেখা উভয় বিষয়টিই যাচাই করতে হবে আলাদা আলাদাভাবে।
নকল ছবি বা ভিডিও চিহ্নিত করা: ছবি আসল-নকল যাচাই করার ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ জ্ঞান কাজে লাগানো যেতে পারবে। যদি কোনও ছবির আকার ছোট ও রেজ্যুলেশন কম হয় তবে তা নকল হওয়ার সুযোগ বেশি। মূলত ভুয়া ছবিগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল ছবিকে ক্রপড, এডিট ও মিরর করে ছবির ক্যাপশন পরিবর্তন করে তা নকল হিসেবে ছড়ানো হয়। তাই যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই ছবিটির প্রকৃত তারিখ, স্থান এবং এটি প্রকাশের প্রেক্ষাপট জানা জরুরি।
গুগল রিভার্স সার্চ-এর মাধ্যমে ছবির শুদ্ধতা যাচাই করা যেতে পারে। অ্যাডোবি ফটোশপের মাধ্যমে বিশেষ বার্তাবাহী ছবিটি সম্পাদনা করা হয়েছে কিনা তা জানতে গুগল ইমেজ রিভার্স সার্চ অপশনটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে https://images.google.com/ ঠিকানায় গিয়ে ছবি বা ছবির লিংকটি সার্চ মেনুতে ড্রপ করতে হবে। অনুসন্ধান বা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে টুল মেনু থেকে ভিজ্যুয়াল সিমিলার বা মোর সাইজ নির্বাচন করারও সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় ছবিতে মিরর ইফেক্ট ব্যবহার করেও ধাঁধার জন্ম দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে টিন আই (https://www.tineye.com) থেকেও সাহায্য মিলবে।
ছবির মতো নকল ভিডিও বের করতে ভিডিওর মধ্যে কোথাও কোনও অসামঞ্জস্যতা আছে কিনা তা বুঝতে চেষ্টা করুন। সাধারণত, ভিডিওতে শ্যাডো, রিফ্লেকশন, আলো ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন উপাদানের শার্পনেস থেকে তা বোঝা যায়। ভিডিওর পরিবেশ-প্রকৃতির অসামঞ্জস্যতা থেকে জোড়া লাগানো, বিকৃত অনুপাত উপলব্ধি করা যায়। এক্ষেত্রে আমরা ক্রমো ব্রাউজার থেকে InViD টুলস ব্যবহার করতে পারি। ইউটিউব, ভিমো, ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক কিংবা টুইটারে প্রকাশিত ছবির লিংকটি ইনভিড এর কি-ফ্রেমস উইন্ডোতে সাবমিট করে থাম্বনেইলগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হয়ে যাবে। এছাড়া প্রকৃত ভিডিও বিষয়ে নিশ্চিত হতে আমরা ব্যবহার করতে পারি অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইউটিউব ডাটা ভিউয়ার (https://citizenevidence.amnestyusa.org)।
ভুয়া খবর বা তথ্য চিহ্নিত করা: ফেসবুকের মতো বিভিন্ন অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে অভিমতকে তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করে ভুল শিরোনামে বানোয়াট খবর উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তাই খবরের ক্ষেত্রে যে গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বা লোগো ব্যবহার করে কোনও সংবাদ বা ছবি অনলাইনে প্রচার করা হচ্ছে তার সত্যতা নিশ্চিত হতে অবশ্যই সেই সংবাদ মাধ্যমের মূল ওয়েবসাইটে যেতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ট্রিবিউন, বিবিসি বাংলা ও প্রথম আলো এমন নকলবাজদের কবলে পড়ে। তাই এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আবেগতাড়িত খবর কেবল একাধিক সূত্রের মাধ্যমে জেনে তারপরই গ্রহণ-বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। খবরের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজের কমনসেন্স, তথ্যসূত্র, সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি নজরে আনতে হবে। খবরের বর্ণনা বাদ দিয়ে যদি বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তাহলে তা বিনা দ্বিধায় গ্রহণ না করাই শ্রেয়। আন্তর্জাতিক খবর যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গুগল ছাড়াও https://www.snopes.com লিংক ব্যবহার করতে পারেন। বাংলার ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট ওয়াচে ঢুঁ দেওয়া যেতে পারে (https://www.fact-watch.org)।
আর গুগলে অন্যদের করা দাবির পর্যালোচনা করে এমন ওয়েব পৃষ্ঠা যদি আপনার থাকে, তাহলে আপনি আপনার ওয়েব পৃষ্ঠাতে ClaimReview স্ট্রাকচার্ড ডেটা এলিমেন্ট অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। যখন সেই দাবির জন্য সার্চ ফলাফলে আপনার পৃষ্ঠাটি দেখানো হয় তখন এই উপাদানটি গুগল সার্চ ফলাফলে সত্যতা যাচাইয়ের সংক্ষিপ্ত ভার্সন দেখানো হয়। এক্ষত্রে সার্চ ফলাফলে সত্যতা যাচাইয়ের অন্তর্ভুক্তি স্বয়ংক্রিভাবে নির্ধারণ করা হয়। সাইটের প্রোগ্রাম্যাটিক র্যাংকিং-এর ওপর ভিত্তি করে সত্যতা যাচাই উপাদানের মান দেওয়া হয়। পৃষ্ঠা র্যাংকিংয়ের মতোই সাইটগুলোর মূল্যায়ন করা হয়: যদি সাইট র্যাংকিং যথেষ্ট ভাল হয়, তাহলে আপনার পৃষ্ঠার সঙ্গে সার্চ ফলাফলে সত্যতা যাচাইয়ের উপাদান দেখানো হতে পারে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং অনুযায়ী চলে; মানুষের হস্তক্ষেপ তখনই করা হয় যখন ব্যবহারকারীর মতামত সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গুগল নিউজ প্রকাশকের মানদণ্ড অথবা স্ট্রাকচার্ড ডাটার জন্য সাধারণ নির্দেশাবলী লঙ্ঘন করছে হিসেবে লেখা হয় অথবা যখন প্রকাশক (নিউজ সাইট হতে পারে আবার নাও হতে পারে) গুগল নিউজের সাধারণ নির্দেশাবলী অনুযায়ী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা অথবা সাইটের মিথ্যা বর্ণনা সম্পর্কিত যথাযথ মান পূরণ না করেন। তাই অনলাইনে খবরের সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মেধা-মনন ও প্রজ্ঞার বিকল্প নেই।