জামশায় বসেছে লালন মেলা

1356

মানিকগঞ্জের জামসায় বসছে লালন মেলা। এই উপলক্ষে দূর দুরান্ত থেকে মানিকগঞ্জের জামসা বাজারে এসে জরো হচ্ছে সাধুরা। সেই জন্য জামসা বাজারে জ্বলছে ধামের যজ্ঞ। যজ্ঞের চারদিকে বসে আছেন নানা বয়সের প্রায় তিন শতাধিক সাধু-সন্ন্যাসী। কেউ জটাধারী, কারও পরিধানে লাল গেরুয়া। আবার কেউ ত্রিশুলের মাথায় কুমণ্ডল বেঁধে যজ্ঞের সামনে বসে আছেন। তাদের একটাই লক্ষ্য- সাধুসঙ্গ করে মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া।

কার্তিকের লক্ষ্মীপূর্ণিমার প্রথম দিন (২৯ অক্টোবর) থেকে বসেছে সাধু সঙ্গের এ মেলা। চলবে পনেরদিন (১৩ নভেম্বর) পর্যন্ত। দিনে দূর থেকে সাধুদের সুর-লহরি পুরোপুরি শোনা না গেলেও সন্ধ্যার পর যজ্ঞের সামনে থেকে উচ্চ স্বরে ভেসে আসে সাধু-ভক্তের কলতান।

সাভার-মানিকগঞ্জ-নবাবগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে যাওয়া জামশা কালিগংগা নদীর ব্রিজ পেরুলেই জামশা সরু রাস্তা। ভ্যান, রিকশা, নছিমন, করিমন, অটোরিকশায় পুরো রাস্তা ঠাসা। পায়ে হাঁটা মানুষেরও কমতি নেই। সাধুদের ধাম যজ্ঞে যাওয়ার রাস্তাই এটি। ভিড়ের কারণে ভ্যান ছাড়তে হলো নদীর ঘাট থেকেই। প্রায় অর্ধমাইল হাঁটতে হয় সাধুর মেলায় যেতে। জামশা বাজরের কাছে আসতেই বাঁশির সুর লহরি শোনা গেল। সঙ্গে ঢোলের শব্দও। সব মিলে ভাব-তরঙ্গের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাঁশির সুর যেন বলতে চাইছে ‘লালন বলে, লালন বলে’। অমন সুরে সুর মেলাচ্ছেন হেঁটে চলা সাধু ভক্তরাও। যেন সবাই দোহারি, সবাই সাধক বনে যেতে চাইছে। নিশানা জামশা সাধুর মেলা।

আজ থেকে ৪২ বছর আগে এমনি দিনে ধরা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন দুর্গা ও রাধা নামের দুই সাধু। তারাই প্রথম আয়োজন করেন সাধুদের মিলন মেলা। দুর্গা ও রাধা সাধুর তিরোধান উপলক্ষে মানিকগঞ্জের সিংগাইর দক্ষিণ জামশা হাটের বট তলায় প্রতিবছর আয়োজন করা হয় সাধুর মেলার। এরই ধারাবাহিকতায় লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিন থেকে (২৯ অক্টোবর-থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত) ১৫ দিন ধরে চলে সাধুর মেলা। শুধু সাধুদের মেলা নয়। এ উপলক্ষে যাত্রাগান, পুতুল নাচ, সার্কাসসহ নানা পন্যের দোকানপাট বসে। ভাঙা-গড়া মিলে প্রায় ১ মাস থাকে মেলা।

অন্য খবর  দোহারে রাইপাড়ার দুই মাদক ব্যবসায়ীর কারাদণ্ড

মেলার প্রথম দিন থেকেই সাধক-বাউলের পদচারণায় ভরে ওঠেছে কালীগঙ্গার তীর। কোনো বাধাই পথ রুদ্ধ করতে পারেনি সাধক-আশেকানদের। সব জঞ্জাল পায়ে মাড়িয়ে শত শত সাধক-সন্ন্যাসী মিলে এক মহামিলনে রূপ নিয়েছে জামশা হাটের বটতলাকে। পুরো জামশা হাট এলাকা হয়ে ওঠেছে সাধকের তীর্থস্থান।

সাধুর মেলা ঘিরে চাকুরিয়া, ভূরাখালি, উত্তর জামশা, দুধঘাটা, বনপালিনসহ জামশা বাজারের আশপাশের গ্রামের পায় প্রতিবাড়িতেই এ উপলক্ষে আত্মীয়-অনাত্মীয় অতিথিদের আগমন ঘটে উল্লেখ করার মত। বিশেষ করে এসময় নব-জামাইদের আনাগোনা বেড়ে যায়।

৬৫ বছর বয়সী আনন্দ সাধু বলছিলেন, ‘প্রায় বিয়াল্লিশ বছর ধরে সাধুর মেলায় (ধাম যজ্ঞে) আসি। দুর্গা ও রাধা সাধুর ধামে সদাই কিনে মন ভরে না। যতই আসি, তৃষ্ণা ততই বাড়ে। এ তৃষ্ণা মেটাবার নয়। এ দুজনের বাণীতে মুক্তি মেলে। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে আত্মাকে শিশুরূপ দিতে তারা পথ দেখিয়েছেন। মুক্তির তাড়না অনুভব করে তাদের দেখানো পথেই হাঁটতে চেষ্টা করছি।’

ধাম যজ্ঞকে ঘিরে সাধু-সন্ন্যাসির গুচ্ছ গুচ্ছ আড্ডাও কম নয়। এসব আড্ডা থেকে ঢোল বাজিয়ে গান গাইছেন তারা। ‘অনুরাগ নইলে কী আর সাধন মেলে…।’ আবার কেউ কেউ গাইছে, ‘খুঁজে ফিরেছেন ‘মানুষ রতন’, যাকে কখনও ‘মনের মানুষ’, ‘পড়শী’ ‘অচিন পাখি’ আবার কখনও ‘সহজ মানুষ’ বলে ডেকেছেন লালন ফকির।

অন্য খবর  নারিশা বাজারে নির্বাচন: কেমন সভাপতি চাই?

লালন ভক্তরাও ‘মনের মানুষ’ খুঁজে ফিরতে দিশেহারা। পরনে সফেদ লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া। নারীদের বসনেও সাদার ছড়াছড়ি। এরা জাতে বিশ্বাসী নয়। সাদায় জাত চেনা যায় না। সাদায় রঙ থাকে না, হিংসা থাকে না। সাদাতেই কালো দূর হয়।

এমনটিই মনে করেন ৭০ বয়সের সাধক শচীন চন্দ্র পাল। তিনি এসেছেন সিরাজগঞ্জ থেকে। তিনিও প্রায় তিন ১২ বছর ধরে এ ধামে আসেন। বলছিলেন, ‘এমন সাধুসঙ্গ দুনিয়ার আর কোথাও মেলানো ভার। সাধুসঙ্গ আমাদের পথ দেখিয়েছে। ও পথেই মুক্তি।’

শচীর সাধকের মতো জয়গুন পাগলী, ইউসুফ সাধু, মো. আব্দুল গফুর, হিসাব আলী, শহীদ পাগল, জালাল পাগলসহ প্রায় তিন শতাধিক সাধু-ভক্ত মনের মানুষ খুঁজে ফিরছেন। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, দোহার, কেরানীগঞ্জসহ সারাদেশ থেকে এ মেলায় আসা সাধুরা খুঁজছেন নিজেকে, নিজের আত্মাকে। যে আত্মায় ভর করে আছে পরমাত্মা। পরমাত্মার দর্শন মানেই তো মনের মানুষের সঙ্গে মহামিলন। এমন মিলন-সাধনায় সাধকেরা তাই সর্বহারা।

আপনার মতামত দিন