দুদকের গণশুনানিঃ তোপের মুখে দোহারসহ ঢাকার সব সাব-রেজিস্ট্রাররা

428

নিজস্ব প্রতিবেদক : অফিসে ঘুষ লেনদেনে দালালের দৌরাত্ম্য, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের নামে রাজস্ব ফাঁকি ও রেজিস্ট্রেশনের নামে অবৈধভাবে বিভিন্ন ফি আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে অনেকটা তোপের মুখে রাজধানীর কয়েকটি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কর্তাব্যক্তিরা।

বুধবার সকালে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস বিষয়ে ফলোআপ গণশুনানিতে বিভিন্ন অঞ্চলের সেবাগ্রহিতাদের অভিযোগের এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।

ঘুষ গ্রহণসহ অবৈধ সম্পদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা সদরের সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদের বিরুদ্ধে এবং জমির শ্রেণি পরিবর্তনের নামে সরকারের বিপুল রাজস্ব ফাঁকির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ড. নাসিরউদ্দিন অনুসন্ধানের ঘোষণা দেন।

আজ কোতোয়ালি, গুলশান ও তেজগাঁওসহ কয়েকটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বিষয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

গণশুনানিতে দোহারের আবুল কাসেমের অভিযোগ, দলিল করতে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সেরেস্তা ফি নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। দলিল লেখকরা একটি দলিলের জন্য কত টাকা নিতে পারেন সে বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এ বিষয়ে গুলশানের সাব-রেজিস্ট্রার বলেন, সেরেস্তা ফি নামে কোনো ফি নেই, এখন পে-অর্ডারের বাইরে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার বলেন, ২০১৪ সালে দলিল লেখকদের ফি সংক্রান্ত নীতিমালা হয়েছিল, কিন্তু এ নিয়ে জটিলতার কারণে সেখানে হয়রানির হচ্ছে। এ বিষয়টি মাননীয় আইজিআরকে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমরা অনুরোধ জানাব।

সাভারের কামরুজ্জামান অভিযোগ করেন, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে স্টাফ না এমন অনেকে থাকেন, তারাই ঘুষের টাকা হ্যান্ডেলিং করেন। নিয়ম না থাকলেও সেরেস্তা ফি বাবদ ৭০০ টাকা নেওয়া হয়। বিশেষ কৌশলে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান করব। এছাড়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে স্টাফ না এমন যারা আছেন সেই বিষয়টি ঢাকা জেলা সাব-রেজিস্ট্রার দেখবেন। তবে যারা ঘুষের টাকা হ্যান্ডেলিং করেন তাদেরকে দুদক বিশেষ কৌশলে আইনের আওতায় আনবে বলে তিনি জানান।

আশুলিয়া থেকে আসা রহিম উদ্দিন বলেন, স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দালালে ভরা। সারাদেশেই একই অবস্থা বিদ্যমান।

অন্য খবর  বর্ষা মৌসুমে দোহার-নবাবগঞ্জে বসেছে কোষা নৌকার হাট

এ বিষয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, বিষয়গুলো আমরা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করছি। কেউ যদি ঘুষ চায় আপনারা দেবেন না। আপনারা ১০৬ নাম্বারে ফোন করে দুদকে অভিযোগ জানাবেন। ঘুষ দেবেন না, এমন সংস্কৃতি চালু করেন।

কেরানীগঞ্জের বেগম বেদৌরা আলী বলেন, জমি রেজিস্ট্রারের সময় শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। সেটা অহরহ হচ্ছে, এর কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য অন্যায়ভাবে হাজার হাজার টাকা নেওয়া হয়ে থাকে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এ নিয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে দলিল করার অভিযোগে গাজীপুরের এক সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। এ ধরনের আরও ঘটনা থাকলে দুদকে অভিযোগ জানাতে তিনি অনুরোধ করেন।

তিনি বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পাসপোর্ট অফিসের মতো দালাল চক্র আছে। কমিশন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।

লালবাগের বাসিন্দা গাজী শহিদুল্লাহ অফিযোগ করে বলেন, আমি ২০১০ সালের একটি দলিলের কপি তুলতে তেজগাঁওয়ের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যাই। দলিলের রশিদের ফটোকপি ও থানার জিডি নিয়ে দলিল উদ্ধারে ঢাকা সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস গেলে সেখান থেকে জনৈক রাসেল (দালাল) ১৩ হাজার টাকা ঘুষ হিসেবে দাবি করেন। বিষয়টি নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। টাকা না দেওয়ায় ওই দলিল তুলতে পারিনি। তাছাড়া দলিল তুলতে কেন আমি এত টাকা দেব?

তিনি বলেন, তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রার অফিস দালাল চক্রের আস্তানা। ওই অফিসের রাসেল ছাড়া মামুন নামের আরো একজন রয়েছে যারা মূলত সাব-রেজিস্ট্রারের ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে থাকেন।

এ বিষয়ে সঞ্চালক ও দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ার সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুসের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, রাসেল তার অফিস স্টাফ নয়। তবে কেন একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার রুমে থাকে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

এ সময় উপস্থিত সবাই সাব-রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করার দাবি করা হলে দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, আমরা তথ্য সংগ্রহ করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে আমি কমিশনার নাসিরউদ্দিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পরবর্তীতে কমিশনার নাসিরউদ্দিন অনুসন্ধানের ঘোষণা দেন।

অন্য খবর  মুজাহিদুল ইসলামের মতো শিক্ষকেরাই জীবনবোধ দিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন

গণশুনানিতে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার বলেন, এসব বিষয়ে আমরা বিভাগীয় তদন্ত করব। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শাহজাহানপুর থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী পারভিন রশিদ অভিযোগ করেন, শাহজাহানপুরের শহীদবাগে তার শ্বশুরের মালিকানাধীন একটি জমি বিক্রি না হলেও অন্য একটি জমি তাদের চৌহদ্দি দেখিয়ে বিক্রি হয়েছে। যে কারণে তারা জমিটি হারিয়েছেন। এতে দলিলের সময় সাব-রেজিস্ট্রার এই কাজটি করতে সহায়তা করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

এ বিষয়ে গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম বলেন, এটা রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত বিষয় না। চৌহদ্দির বিষয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ঢাকা জেলা সাব-রেজিস্ট্রার বলেন, যেহেতু জমিটি দখল হয়ে গেছে, এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব। এছাড়া উচ্ছেদের জন্য তিনি মামলাও করতে পারেন। বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে দেখার জন্য দুদকের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হবে বলে কমিশনার নাসিরউদ্দিন জানিয়েছেন।

গণশুনানিতে দুদক কমিশনার ড. নাসিরউদ্দিন বলেন, সরকার বা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করার কাজ আমাদের নয়। অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার অভিযোগ বিষয়ে সাভার সাব-রেজিস্ট্রার অফিসকে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে নেওয়া হলো বলে জানান তিনি। গত এক বছর এই অফিসে যত দলিল হয়েছে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সরকারের কত টাকা রাজস্ব ফাকিঁ দেওয়া হয়েছে, তা খুজেঁ বের করবে দুদক। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর ও পাশের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা হবে এবং এসব অফিস দালালমুক্ত করতে বারবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকারকে নির্দেশ দেন দুদকের এ কমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

আপনার মতামত দিন