শনিবার সৌদি আরবের ইয়েমেন সীমান্তের জাজান প্রদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সাত বাংলাদেশি নিহত হন। নিহতদের বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহত সাত জনের পরিবারেই ৪-৫ জন করে সদস্য আর নিহতরাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বজনকে হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে সাতটি পরিবার।
নরসিংদীর ইদেন মিয়ার পরিবারও দিশেহারা: সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাত জন হলেন– নরসিংদীর সদর উপজেলার চরাঞ্চল করিমপুর ইউনিয়নের বাউশিয়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে আমির হোসেন (৫০), একই উপজেলার চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নের বীরগাঁও গ্রামের মৃত সিরাজ বেপারীর ছেলে ইদেন মিয়া (৩৫), টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল গ্রামের আব্দুর রহিম মিয়ার ছেলে আমিন মিয়া (৩২), কালিহাতী উপজেলার কস্তুরিপাড়া এলাকার হামেদ আলীর ছেলে শফিকুল ইসলাম (৩৫), কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার জিনারি ইউনিয়নের চরহাজীপুর গ্রামের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মো. জসিম উদ্দিন (৪৪), সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার শহীদনগর বালকদি গ্রামের আকবর আলীর ছেলে মো. দুলাল আহমদ ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার নটেরটাক গ্রামের মতিউর রহমান।
আমির হোসেনের শোকে নির্বাক হয়ে রয়েছেন তার স্বজনরা। আমির হোসেনই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ধার-দেনা করে তিনি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। সেই ঋণও পরিশোধ হয়নি।
আমির হোসেনের স্ত্রী শাহেনা আক্তার জানান, দুই বছর আগে শেষবার ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন তার স্বামী। আগামী মাসে আবারও ছুটিতে দেশে আসার কথা ছিল কিন্তু এখন সারাজীবনের জন্য ছুটি নিয়েছেন। শাহেনা আক্তার বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়া এখন আমি কীভাবে দিন পার করবো?’
সৌদিতে নিহত ইদেন মিয়ার বীরগাঁও গ্রামের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে ইদেন মিয়ার পরিবারও। স্বামী হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন ইদেন মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা।
আত্মীয়-স্বজনরা জানান, সংসারে সুদিন ফেরানোর আশায় কৃষি কাজ ছেড়ে সৌদি আরবে যান ইদেন মিয়া। ওই সময় তার পরিবার সাড়ে ৮ লাখ টাকা ঋণ করে। এখনও ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়নি।
ইদেন মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘অভাবের সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিও আর নেই। তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবন কীভাবে কাটাবো, ভাবতে পারছি না।’
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে দু’জনের বাড়ি টাঙ্গাইলে। নিহত দুইজন হলেন- টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল গ্রামের আব্দুর রহিম মিয়ার ছেলে আমিন মিয়া (৩২) এবং কালিহাতী উপজেলার কস্তুরিপাড়া এলাকার হামেদ আলীর ছেলে শফিকুল ইসলাম (৩৫)।
দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল গ্রামের নিহত আমিন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারে চলছে শোকের মাতম। সন্তানকে হারিয়ে মা পাগলপ্রায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহতের বাবা আব্দুর রহিম মিয়া বলেন, ‘আমি খুব অসহায় মানুষ। ধার-দেনা করে ছেলেকে গত নভেম্বরে সৌদি পাঠিয়েছি। আমার এখন কোনও সহায় সম্বল কিছু নাই। সরকারের কাছে একটাই আবেদন করি আমার ছেলেকে যেন দ্রুত দেশে ফিরিয়ে দেয়। আমি আর কিছু চাই না।’
কালিহাতী উপজেলার কস্তুরিপাড়া এলাকার আব্দুল হামিদ আলীর ছেলে শফিকুল সিকদারের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। হতদরিদ্র পরিবার শফিকুলকে হারিয়ে হতাশায় পড়েছে। দেড় বছর আগে সৌদি গেলেও ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি শফিকুল। জমাজমি বিক্রি করে শফিকুলকে সৌদি পাঠিয়ে পরিবার এখন নিঃস্ব। শফিকুলের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের মো. জসিম উদ্দিনের পরিবারের আহাজারি: দুই বছর আগে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় স্ত্রী-সন্তান রেখে সৌদিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের জসিম। পরিবার-পরিজনের মুখে হাসি ফোটানো ও বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করাই ছিল স্বপ্ন। সব স্বপ্ন মলিন হয়ে গেছে নিমিষে। পরিবার আর আত্মীয়-স্বজনের কান্নায় ভারী এখন চারিদিক। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার।
নিহত জসিমের ভাই আবু বকর সিদ্দিক জানান, বিভিন্ন মানুষের কাছে ধার-দেনা করে তাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। দুই বছরে মাত্র ৩ লাখ টাকার মতো তিনি বাড়িতে পাঠান। এখন তার তিন সন্তানকে কিভাবে মানুষ করবো তা ভেবে পাচ্ছি না।
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সোনারগাঁয়ের আনন্দবাজার নটেরটাক গ্রামের মতিউর রহমানের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সদস্যকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার।
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিক দুলালের স্ত্রী স্বপ্না বেগম জানান, ব্র্যাকসহ বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তাকে বিদেশ পাঠানো হয়েছিল। কিভাবে ধারের টাকা পরিশোধ করবো, এখন একটাই চিন্তা। তার তিন ছেলে রয়েছে বলে জানিয়েছেন আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি। বড় ছেলে নয় বছরের সায়েম, পাঁচ বছরের ছেলে ছাব্বির এবং ৫ মাসের ছেলে বায়োজিদ।