দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত চিত্র জানতে তিন স্তরে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি এসব পরিদর্শনের প্রতিবেদন তাৎক্ষণিক অনলাইনে পাঠানোও বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। অনলাইনে প্রতিবেদন দাখিল কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হচ্ছে আজ।
পরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রেটিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্ন ফাঁস, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, বই নিয়ে ব্যবসা, জাল সনদে নিয়োগসহ নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর এসব অপকর্মকে সুযোগ বানিয়ে পরিদর্শনে যাওয়া অসৎ কর্মকর্তারা ঘুষ বাণিজ্যে লিপ্ত হন। ফলে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসে না।
বছরের পর বছর স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি চলে আসছে। এ অবস্থায় উভয় অংশের অপকর্ম রুখতেই এবার তিন স্তরে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে সরকার।
এর অংশ হিসেবেই দুর্নীতি ও অনিয়ম মুক্ত এবং স্বচ্ছতা ও লেখাপড়ার মানের বিচারে সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাকে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে। এগুলো হল- অসাধারণ, অতি উত্তম, উত্তম, চলতি মান ও নিন্মমান। একজন অভিভাবক বা যে কেউ সার্চ দিয়ে ডিআইএর ওয়েবসাইটে দেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মান সম্পর্কে একনজরে জানতে পারবেন। এজন্য প্রতিষ্ঠানের নাম পাঁচটি রঙে লেখা হবে। অসাধারণ প্রতিষ্ঠানের নাম সবুজ রঙে রাঙানো হবে। আকাশি রঙে অতি উত্তম, কমলা রঙে উত্তম, গাঢ় নীল রঙে চলতি মান এবং লাল রঙে থাকবে নিন্মমানের প্রতিষ্ঠানের নাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিআইএ এসব কাজ হাতে নিয়েছে। অসৎ কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্যের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এক সময় দুর্নীতির ‘মধুর হাঁড়ি’ আখ্যা পেয়েছিল। দেশের ৩৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ডিআইএ নজরদারি করছে।
ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক আহাম্মেদ সাজ্জাদ রশীদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছি। পরিদর্শন ও প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষার মাধ্যমে কাজটি করা হয়। এটি আরও কার্যকর ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে আমরা তিন স্তরে পরিদর্শন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, তিন স্তরের পরিদর্শনের মধ্যে রয়েছে, পিয়ার ইন্সপেকশন বা সমজাতীয় পরিদর্শন। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান প্রথমে নিজের প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করে ডিআইএর অনলাইনে তথ্য দেবেন। এরপর সমজাতীয় আরেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ওই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে পাঠানো হবে। তিনিও একইভাবে পরিদর্শিত প্রতিষ্ঠানের তথ্য ডিআইএর কাছে অনলাইনে পাঠাবেন। সেটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিবেদন হিসেবে তৈরি হবে। এ দুই প্রতিবেদনের দুর্বলতা থাকলে সেখানে তৃতীয় স্তর বা ডিআইএ পরিদর্শন করবে। তখন ইন্সপেক্টরের নেতৃত্বে ডিআইএ টিম চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে শুধু তৃতীয় স্তর বা ইন্সপেক্টরের পরিদর্শনের রীতি প্রচলিত আছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ডিআইএর এক বা একাধিক কর্মকর্তা অভিযুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় যান। সেখান থেকে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু অভিযোগ, অসৎ কর্মকর্তারা পরিদর্শনের পর প্রতিবেদন দাখিলে দুই বছরও কাটিয়ে দেন। অনেক সময়ে পরিদর্শন করে এসে ঢাকায় দরকষাকষিতে লিপ্ত হন। নিজের বাসা কিংবা বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ বা শপিংমলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নেন। এভাবে এ পরিদর্শনে ঘুষ বাণিজ্যের মহোৎসব হয় বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ আছে। এমন অভিযোগে সম্প্রতি ডিআইএর একজন কর্মকর্তাকে ঢাকার একটি শপিংমল থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গ্রেফতার করেছে। তৃতীয় স্তরের দুর্নীতি বন্ধেই ইন্সপেক্টরদের প্রতিষ্ঠানে বসেই অনলাইনে তথ্য আপলোড (দাখিল) এবং পরিদর্শনের ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের বিধান করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে আজ ডিআইএ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা করেছে। সেখানে কর্মকর্তাদের মধ্যে ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়। এর আগে একই কাজে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, সংস্থাটির বিরুদ্ধে এক সময় নানা অভিযোগ ছিল। এজন্য এ বছরের ৩ জানুয়ারি ডিআইএ পরিদর্শনকালে শিক্ষামন্ত্রী আলটিমেটাম দেন। সেটা মাথায় রেখে এক বছর কাজ করেছি। আগের চেয়ে ডিআইএর সেবার মান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন করতে চাই। এজন্য অপ্রীতিকর অভিযোগ বন্ধে সিস্টেম প্রবর্তন করতে যাচ্ছি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে চলে আসতে কর্মকর্তাদের বাধ্য করবে সিস্টেম।
বিপুল সরকার আরও বলেন, ইমেইলে সব ধরনের যোগাযোগ, ই-নথি বাস্তবায়ন, ওয়েবসাইট থেকে ফরম নেয়া, ডিআইএ অনলাইনে তথ্য পাঠানো, প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরির হোমওয়ার্কসহ ১১ ধরনের কাজ করতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতর ও বাইরে স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমরা আশা করি।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বছরে একবার করে পরিদর্শনের কথা থাকলেও জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি পারছে না। এজন্য বর্তমানে অভিযোগ ও বাই রোটেশনের ভিত্তিতে সাধারণ পরিদর্শন করা হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, এ প্রক্রিয়ায় ২০০৯ সালের দিকে বছরে গড়ে ৮০০-৯০০ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হতো। যদিও কয়েক বছর ধরে এটি বেড়ে গড়ে দুই হাজার হয়েছে। এ অবস্থায় উল্লিখিত তিন ধাপের পরিদর্শনের মধ্যে পিয়ার ইন্সপেকশন বা প্রথম দু’ধরনের পরিদর্শনে অধীনে প্রতি বছরই প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরের শুরুতে মাত্র ৭ দিনে পরিদর্শন শেষ করা হবে সব প্রতিষ্ঠান। এ উপলক্ষে পিয়ার ইন্সপেকশন সপ্তাহ পালন করা হবে।