বিশ্বের কোনো দেশ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে রাশিয়া এর ব্যতিক্রম। ১৯৬৭ সালে সিরিয়া, মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর থেকে ইসরায়েল ‘জেরুজালেম দিবস’ পালন করে আসছে। এই দিনে ইসরায়েলি তরুণ তরুণীরা রাস্তায় নেমে আসেন, হাতে থাকে তাদের ইসরায়েলি পতাকা, তারা ফিলিস্তিন,আরব ও মুসলিম বিরোধী নানা শ্লোগান দিতে থাকে।

তাদের অনেকে জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু, ধ্বংস ও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কামনা করে। তাদের একটা বিরাট অংশ জেরুজালেমের পুরাতন শহরে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে মিছিল ও বিক্ষোভ করে উস্কানিমূলক শ্লোগান দেন, দাবি জানান ফিলিস্তিনিদের দোকানপাট ও বাড়ি ঘর উচ্ছেদের।

১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধে ইসরায়েল জেরুজালেমের পশ্চিম অংশের অর্ধেক দখল করে নেয়। জেরুজালেম দিবসকে ইসরায়েলিরা পুনর্গঠন হিসেবে দেখে এবং পূর্ব ও পশ্চিমের রাজধানী হিসেবে মনে করে। পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এলাকাটিতে দেশটির কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। তবে জেরুজালেম ইসরায়েল রাষ্ট্রের অধিক্ষেত্র বা মালিকানাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি দেয়নি, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। জেরুজালেমের বর্তমান পরিস্থিতি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের সুরাহা হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা।

১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভক্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফিলিস্তিন, ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়ার পর জেরুজালেম বিশেষ মর্যাদা পায়, যা আন্তর্জাতিক সার্বভৌমত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলে আসে। জেরুজালেমের এ ধর্মীয় গুরুত্বের কারণ হচ্ছে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের অনুসারীরা যার হযরত ইব্রাহিম (আ:)কে জাতির পিতা হিসেবে মানেন এবং তাদের প্রত্যেকের জন্যে জেরুজালেমের ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার জন্যে জাতিসংঘের সুপারিশের পর ইসরায়েল জেরুজালেমের পশ্চিমাঞ্চল দখল করে রাষ্ট্রটির ভূখ- অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জেরুজালেমের পূর্বাঞ্চলের অর্ধেক দখল করে যা ওই সময় জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সেখানে ইসরায়েলি আইন সম্প্রসারণ করে এবং কার্যকর হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে ইসরায়েলের ভূখন্ড অংশ বিশেষে পরিণত করে। ১৯৮০ সালে ইসরায়েল ‘জেরুজালেম আইন’ পাশ করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে বলে এলাকাটি অবিভক্ত ও একতাবদ্ধ। এরপর পূর্ব জেরুজালেম আয়ত্বে আনার দিকে আইনগতভাবে অগ্রসর হয় ইসরায়েল।

অন্য খবর  বাংলাদেশের বেসরকারি উচ্চ পদগুলো ভারতীয়দের দখলে

জবাবে জাতিসংঘ্য জেরুজালেম নিয়ে ১৯৮০সালে সংশোধিত ৪৭৮ আইনটি অকার্যকর ও বাতিল ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যুক্তরাষ্ট্র এখনো পূর্ব জেরুজালেমকে দখলকৃত অঞ্চল বলেই স্বীকৃতি দেয়। একই সঙ্গে বিশ্বের কোনো দেশ জেরুজালেমের কোনো অংশকেই ইসরায়েলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দেয়নি। শুধুমাত্র রাশিয়া গত বছর পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। এখনো ইসরায়েলে সকল বিদেশি দূতাবাস তেলআবিবে।

পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি অবৈধ দখলদারিত্ব একাধিক আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করেছে। অথচ দখলদারি শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের জেরুজালেমে সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার কোনো অধিকার নেই। এরপরও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি। সেখানে ৪ লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনি স্থায়ী আবাসন পরিচয়পত্র নিয়ে বাস করছে। তাদের কাছে এখনো জর্ডানের অস্থায়ী পাসপোর্ট রয়েছে যাতে জাতীয় সনাক্তকারী নম্বর নেই। তার মানে তারা পুরোপুরি জর্ডানের নাগরিক নয়। জর্ডানে কাজ করতে হলেও তাদের ওয়ার্কপারমিট প্রয়োজন পড়ে, সরকারি চাকরি করতে পারে না, কোনো সুযোগ সুবিধা পান না, উদাহরণ দেওয়া যায় যেমন তারা শিক্ষা ফি হ্রাসের সুযোগ পান না।

জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিরা মূলত রাষ্ট্রহীন, সীমিত আইনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, না তারা ইসরায়েলের নাগরিক, না জর্ডানের এমনকি ফিলিস্তিনেরও নয়। ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের বিদেশি অভিবাসি মনে করে, যদিও সেটাই তাদের জন্মভূমি এবং ফিলিস্তিনিরা সেখানে জন্ম নিয়েও ইসরায়েলের অনুগ্রহে বাস করে এবং তা সঠিকভাবে নয়। ফিলিস্তিনিরা সবসময় আতঙ্কে থাকে কখন তাদের বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়, এজন্যে তাদের বসবাসের অধিকার নিশ্চিত জরুরি। যদি কোনো ফিলিস্তিনি জেরুজালেমের বাইরে কিছু সময়ের জন্যে বাস করে যদিও তা অন্যদেশেও হয় কিংবা পশ্চিম তীরে হোক তাহলে তার জেরুজালেমে বাস করার অধিকার হারানোর ভয় থাকে। তাদের মধ্যে কেউ যদি প্রমাণ করতে না পারে যে তার জীবন যাত্রা জেরুজালেম কেন্দ্রীক এবং অব্যাহতভাবে সে সেখানেই বাস করে আসছে, তাহলে জেরুজালেমে জন্ম নেওয়া সত্তে¦ও সে সেখানে বাস করার অধিকার হারাতে পারে। তাদেরকে জেরুজালেমে বাস করার পক্ষে একাধিক কাগজপত্র, ভাড়ার চুক্তি, বেতনের স্লিপ, স্বত্ত্বপত্র সহ নানা ধরনের দলিল দেখাতে হয়। অন্যকোনো দেশের নাগরিক হলে তা তার বিপক্ষে বিবেচিত হয়।

অন্য খবর  ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

সব সময় বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের কোনো ইহুদি নাগরিক ইসরায়েলে বাস করার বা নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘রিটার্ন ল’ অনুযায়ী সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে জেরুজালেমে ১৪ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিককে বসবাসের অধিকার বাতিল করেছে ইসরায়েল। এছাড়া জেরুজালেম শহরের ওপর ইসরায়েলী নিয়ন্ত্রণের যে অব্যাহত প্রক্রিয়া চলছে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। জাতিসংঘ একাধিক প্রস্তাব পাশ করেছে এই বলে যে ইসরায়েলের ‘সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট’ চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন। যা একটি অধিবাসীকে তার জন্মভূমি বা দেশ থেকে নিষিদ্ধ করে এবং দখলকৃত ভূমিতে রুপান্তর হয়।

এর পেছনে কারণও অনেক। ইসরায়েলী দখলদারিত্বকে স্থায়ী হিসেবে নিশ্চিত করতে সামরিক শাসনের মধ্যে দিয়ে জেরুজালেমে দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি ও দখলদার রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়াস ছাড়াও বর্ণবিদ্বেষ প্রতিরোধের মাধ্যমে সেখানকার নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট পরিবর্তন করে দেওয়া।

১৯৬৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল জেরুজালেমে ডজনেরও বেশি আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছে ইহুদি নাগরিকদের জন্যে। এসব প্রকল্পগুলো পূর্ব জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের আশেপাশে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরায় ২ লাখ ইহুদি নাগরিক বাস করছে পূর্ব জেরুজালেমে। একটি আবাসিক প্রকল্পে বাস করছে ৪৪ হাজার ইসরায়েলি নাগরিক। তাদের এধরনের বসতিগুলো ফিলিস্তিনিদের বসবাসে ও নিরাপত্তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন ও গোপনীয়তা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ইসরায়েলের দাবি যখন জেরুজালেম অবিভক্ত রাজধানী, তখন বাস্তবতা হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা সেখানে বাস করতে যেয়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতার শিকার হয়। নানা শর্তের বেড়াজালে যখন ফিলিস্তিনিদের বাস করতে হয় তখন জেরুজালেমে ইহুদি নাগরিকরা সব ধরনের স্বাভাবিক নাগরিক সুযোগ ও সুবিধা লাভ করেন ও সে জন্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গ্যারান্টি থাকে।

আপনার মতামত দিন