এইচএসসির ফলের এই ছন্দপতনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এর পেছনে তারা ৬টি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো হলো: প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন, অন্য বোর্ডের প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়া, প্রশ্ন ফাঁসের গুজব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নতুন বিষয় বাধ্যতামূলক করা এবং ইংরেজি ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে বেশি অকৃতকার্য হওয়া। তারা বলছেন, সরকারের উচিত এসব ব্যাপারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
ঢাকার একাধিক কলেজের শিক্ষকরা বলেছেন, গত বছর এইচএসসিতে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রশ্ন ফাঁস হবে এমন আশা নিয়ে ছিল। এ কারণে তারা পরীক্ষায় ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়নি। ফলে পরীক্ষায় তারা ভালো করেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবার ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ নামে একটি বিষয় আবশ্যিক করা হয়। এ বিষয়টিতে অনেক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতিতে এখনো অনেক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। শুধুমাত্র যারা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন ও খাতা মূল্যায়ন করেন তারাই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। যেসব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে, সেসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারেননি।
তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ইংরেজিতে, সিলেট শিক্ষাবোর্ডে যুক্তিবিদ্যা ও ইংরেজিতে, যশোরে ইংরেজিতে, চট্টগ্রাম বোর্ডে ইংরেজি, বাংলা ও পৌরনীতিতে শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করেছে।
যশোর বোর্ডের খারাপ ফলাফলের প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলে। অন্যান্য বোর্ডের ফলাফল তেমন হেরফের না হলেও যশোর বোর্ডে ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হয়েছে। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
তাদের ভাষ্য, যশোর বোর্ডের খারাপ ফলাফলের কারণেই সার্বিক ফল গত বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে। কী কারণে এমনটা হলো সেটাও খুঁজে বের করা হবে বলে জানান তারা।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘এবারের যশোর বোর্ডের ফলাফলে আমরা থান্ডার্ড হয়েছি। কীভাবে এটা সম্ভব হলো। এতো খারাপ ফলাফল তো হতে পারে না। যশোর বোর্ডের খারাপ ফলাফলের কারণেই সার্বিকভাবে ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো কেন এমনটা হলো। আমাদের মন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।’
যশোর বোর্ডের খারাপ ফলাফলের কারণ সম্পর্কে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল আলম খান বলেন, ‘এবছর ৩২ সেট প্রশ্নের মধ্য থেকে প্রশ্নপত্র বাছাই করা হয়েছে। যশোর বোর্ডের কাছে যে প্রশ্নসেট পড়েছে সেটি ছিল খুবই কঠিন। সেই প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে উচ্চ মাধ্যমিকে স্ট্যান্ডার্ড ছিল না সেই প্রশ্নপত্র। সেই প্রশ্নপত্র ছিল উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলের শিক্ষার্থীদের বোধগম্যের বাইরে। বিশেষ করে ইংরেজি বিষয়ের যে প্রশ্ন হয়েছে তা মোটেই শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে ছিল না।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে এমন কিছু শিক্ষক আছেন- যারা প্রশ্নপত্রে এমন পাণ্ডিত্য দেখান যা মোটেই কাম্য নয়।’
তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, ‘এটি খতিয়ে দেখলেই এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা ধরা পড়ে যাবেন।
বোর্ডের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘সাধারণত কোনো বোর্ডের প্রশ্নপত্র নির্ধারণ হয় ওই বোর্ডের শিক্ষকদের ধারা প্রণীত চার সেট প্রশ্নপত্র থেকে। তাহলে প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের নাগালের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। কিন্তু এবার জাতীয়ভাবে ৩২ সেট প্রশ্নপত্র থেকে বাছাই করা হয়েছে। যার কারণে যশোর বোর্ডের শিক্ষকরা যে প্রশ্ন সেট তৈরি করেছে সেগুলো লটারিতে তারা পায়নি। তারা পেয়েছে অন্য প্রশ্নসেট।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর শিক্ষাবোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্র খুবই কঠিন হয়েছিল। পরীক্ষার দিন অনেক শিক্ষার্থীই বিষয়টি জানিয়েছিলেন। পরীক্ষার ফলাফলেও এর প্রতিফলন দেখা গেল।
এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ কমেছে। ১০টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ ফলাফল হয়েছে যশোর শিক্ষা বোর্ডে। এ বোর্ডের পাসের হার ৪৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর ফেল করেছেন ৫৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এটি যশোর শিক্ষাবোর্ডে ফলাফল খারাপের দিক থেকে রেকর্ড।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ইংরেজিতে প্রায় অর্ধেক পরীক্ষার্থী ফেল করছে। তারপরও গ্রেস নম্বর দিয়ে কোনো শিক্ষার্থীকে পাস করানো হয়নি। বলা যায় এই একটি বিষয়ের কারণেই পাসের হার কমে গেছে।