জয়পাড়াতে পিনু খানের কাবিখা প্রকল্পে রাস্তার টাকা আত্মসাৎ!

280

নিউজ৩৯♦  যেখানে ইটের সলিং রাস্তা করার জন্য কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) প্রকল্প গ্রহণ করা হয় সেখানে এখন ধঞ্চে ক্ষেত। খাতা-কলমে কাজ দেখিয়ে প্রকল্পের পুরো টাকাও তুলে নেয়া হয়েছে। এমন ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলায়। প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের এই অভিযোগ সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি পিনু খানের দিকে। কেননা, এই প্রকল্পটি তার নিজের নামেই বরাদ্দ হয়।

বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ-অসন্তোষ থাকলেও প্রভাবশালী এমপির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। তবে উপজেলার আইনশৃংখলা কমিটির সভায় পিনু খানের উপস্থিতিতেই ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক চেয়ারম্যান এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চেয়ারম্যানরা এমপি পিনু খানকে ‘চোর’ ও প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎকারী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। কিন্তু পিনু খান এসবের কোনো জবাব দেননি।

এদিকে এভাবে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে পিনু খান বলেন, ‘যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে তাদের কাছে এ বিষয়ে খোঁজ নেন। এরপর তিনি আর কোনো প্রশ্ন না নিয়েই মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।’

ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি খাত থেকে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা-নগদ টাকা) কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য পিনু খানের (মহিলা আসন-২৩) অনুকূলে দোহার উপজেলার জন্য ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই বরাদ্দে তিনি চারটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। এরমধ্যে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে উত্তর জয়পাড়া খুদি মুন্সি ও বাদশার বাড়ি থেকে মহিউদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ, ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে হাকিমের বাড়ির মাথা থেকে হরমুজ ও মতি মোল্লার জমি থেকে চকের রাস্তা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার, সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে কার্তিকপুর স্কুলের মাঠ ভরাট ও উন্নয়ন করা এবং দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে তারা মিয়ার বাড়ি থেকে নূর শরীফের বাড়ি হয়ে বেপারি বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ।

অন্য খবর  বাহ্রা ও কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ

দোহারের উত্তর জয়পাড়া এলাকায় দেখা গেছে, একশ’ গজের মধ্যেই পাশাপাশি দুটি প্রকল্প। হাকিমের বাড়ির মাথা থেকে পাকা রাস্তা (চক) পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে যে রাস্তা নির্মাণ করার কথা সেখানে রাস্তার কোনো অস্তিত্বই নেই। অথচ প্রকল্পের কাগজপত্র অনুযায়ী সেখানে গাড়ি চলার উপযোগী এক নম্বর ইটের সলিং করা ২০ ফুট চওড়া রাস্তা থাকার কথা। এই রাস্তার ভাঙনরোধে গজারি কাঠের মোটা খুঁটি গেড়ে ও ড্রাম শিট দিয়ে প্রটেকশন দেয়াল তৈরির কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এসব দূরে থাক, রাস্তারই কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শুধুই ধঞ্চে ক্ষেত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলাকার বাসিন্দা মঞ্জুর হোসেন জানান, ‘বুঝেন না ভাই, সব টাকা খাওয়ার ধান্ধা। নামেমাত্র প্রকল্প দেখিয়ে দুয়েক কোদাল মাটি ফেলে প্রকল্পের পুরো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর এসব টাকা আত্মসাৎ করেছেন এমপি পিনু খান ও মহিলা লীগের নেত্রী এবং উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনারকলি পুতুল।’ 

একই কথা বললেন জয়পাড়া পৌরসভার বাসিন্দা হালিম মুন্সি। তিনি বলেন, ‘যেখানে ইটের সলিং করা রাস্তার কথা বলছেন সেখানে একটি ইটের চিহ্নও নেই। পিনু খান নিজে এসে দেখুক তিনি তার নির্মাণ করা কাল্পনিক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন কিনা?’

এই রাস্তার পূর্ব পাশের একটি প্লটের পরই আরেকটি প্রকল্প। এটির নাম উত্তর জয়পাড়া খুদি মুন্সি ও বাদশার বাড়ি থেকে মহিউদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এই রাস্তাটিও ইটের সলিং করে তৈরি করার কথা। পাশে গজারি কাঠ পুঁতে ও ড্রাম শিট গেঁথে দিয়ে রাস্তা রক্ষাকারী দেয়াল (পেলাসায়টিং) নির্মাণের কথা। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে দু-একটি বাঁশ ও রেইনট্রি কড়ই গাছের ডাল দিয়ে নামেমাত্র বাঁধ তৈরি করা হয়েছে, যা বর্ষা আসার আগেই ভেঙে গেছে। এ ছাড়া রাস্তায় এক নম্বর ইট দিয়ে সিঙ্গেল সলিং করার কথা প্রকল্পে বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ইটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ওই সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল তো দূরে থাক হেঁটে চলাও দুষ্কর। 

অন্য খবর  দোহারে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক জনসচেতনতামূলক সেমিনার

স্থানীয় বাসিন্দা শুক্কুর আলী মোল্লা এ বিষয়ে জানান, ‘কাজ না করেই রাস্তার টাকা মেরে খেয়েছেন এমপি পিনু খান। গরিবের হক মাইরা এখন তিনি ধরা পড়ছেন।’

সূত্র জানায়, চারটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন দোহার পৌরসভার কাউন্সিলর আলমাছ উদ্দিন। কাজ না করে টাকা তুলে নেয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়। সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আনারকলি পুতুল আপার অনুরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হই। কিন্তু আমাকে জোর করে এই পদে রাখা হয়েছে। অথচ কোনো কাজ না করিয়েই তারা টাকা নিয়ে গেছে। আসলে আমার কিছুই করার ছিল না। আমি এই প্রকল্পে সম্পৃক্তও ছিলাম না। পুতুল আপাকে বলেছি, মানুষ আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইছে। কিন্তু আমি জবাব দিতে পারছি না। আপনি দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে দেন। কিন্তু তারা আমার কথা শুনছে না।’

ধঞ্চে ক্ষেতকে রাস্তা দেখিয়ে কবিখার টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে আনারকলি পুতুল বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এগুলো নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। আমি নিজে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আগামী শুকনো মৌসুমে পারিবারিক টাকা দিয়ে হলেও রাস্তাটি তৈরি করে দেব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদারকির দায়িত্বে থাকা দোহার উপজেলা পরিষদের পিআইও মো. হাবীব উল্লাহ মিয়া জানান, ‘এমপি পিনু খান তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাজ না করেই প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন। টাকা নেয়ার আগে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তারা রাস্তা করে দিচ্ছেন না।’

আপনার মতামত দিন