বাংলাদেশকে পাখির দেশ বলা যায়, ছোট এই দেশ পাখিতে সমৃদ্ধ। ছোট এই দেশে আছে প্রায় সাতশ’ প্রজাতির পাখি যেখানে বহুগুণ বড় ভারতে আছে বারো শতের মত পাখির প্রজাতি। যদিও দেশের বেশ কিছু পাখি দুর্লভ এবং পরিযায়ী তারপরও এখানে বৈচিত্র আছে। একই সাথে আছে অনেক শত্রু, তাই দিনে দিনে পাখির সংখ্যা কমছে। তবু মাঠ-ঘাট, বন-জঙ্গল এমনকি শহরেও পাখি বাস করে। আকারে, বর্ণে, সৌন্দর্যে বিচিত্র এই পাখিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দশটি পাখির তালিকা করা কঠিন, কারণ সুন্দর পাখির সংখ্যা প্রচুর। আসলে পাখি মাত্রই সুন্দর।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ১০ পাখি:
১০. হুদহুদ
লেখক বনফুল হুদহুদের (Hoopoe) নাম রেখেছিলেন মোহনচূড়া। পাখিটির শরীর বাদামি এবং ডানা ও লেজে সাদা-কালো দাগ রয়েছে। মাথায় সুন্দর একটি ঝুঁটি। সেই ঝুঁটির হলদে বাদামি পালকের মাথাটা কালো রঙের। উত্তোজিত হলে ঝুটি মেলে দেয়, তখন মুকুটের মত লাগে। বাদামি পালকের মাথাটা কালো। এটি মেঠো পাখি, গ্রামে ঘরবাড়ির আঙ্গিনায় দেখতে পাওয়া যায়। বাসা করে গাছের কোটরে, পুরনো দেয়ালের ফাঁক-ফোঁকরে। প্রায় সারা দেশই বাস করে।
পবিত্র কুরআনে এই সোলায়মান (আ.) এর ঘটনায় এই পাখির উল্লেখ আছে, তাই একে সোলায়মান পাখিও ডাকা হয়।
৯. মথুরা
নীলচে কালো রঙেরর শরীর আর মাথায় একটু লাল, এবং তার উপর ঝুটি, দেখতে কিছুটা মোরগের মত, এই হল- মথুরা। ইংরেজি নাম Kalij Pheasant. এর মধ্যে একটা রাজকীয় ভাব আছে। বিলুপ্তপ্রায় মথুরা সিলেট বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনে দেখা যায়। ফটোগ্রাফাররা এই বহু আকঙ্খিত পাখির ছবি তুলতে ছুটে যান সাতছড়ি বা চট্টগ্রামের বনে।
৮. টিয়া
টিয়া মাত্রই সুন্দর। বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির টিয়া আছে। টিয়া নামে আমরা যেটিকে ডাকি সেটি হল Rose-ringed parakeet বা সবুজ টিয়া। এটি আমাদের সবচেয়ে পরিচিত টিয়া, দোহার-নবাবগঞ্জে একসময় প্রচুর দেখা যেত, এখন অনেক কমে গেলেও টিকে আছে। সবচেয়ে সুন্দর টিয়া বলা যায় হীরামন টিয়াকে, মাথা পাকা আলুবোখারার মত গোলাপি-লাল। বাসন্তি লটকন টিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট ও সবচে’ দুর্লভ টিয়া, এর পুরোটাই সবুজ, পিঠে একটু লাল, লেজ ছোট। ধূসর-মাথা টিয়াও বেশ দুলর্ভ, শুধু পাহাড়ি বনে দেখা যায়। সবচেয়ে বড় টিয়ার নাম চন্দনা টিয়া, এটি বেশ দুলর্ভ। এছড়া আছে ফুলমাথা টিয়া ও মদনা টিয়া।
৭. মৌটুসি
দেশে ৬ প্রজাতির মৌটুসি (Sunbird) দেখা যায়, আরও ৩ প্রজাতি বিলুপ্ত বা খুবই বিরল। এই ছয় প্রজাতির মধ্যে সবগুলোই সুন্দর। বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট পাখিগুলোর অন্যতম মৌটুসির বেশিরভাগ দেখা যায় সিলেট বিভাগের বনে। আমাদের আশেপাশে বাস করে বেগুনি মৌটুসি, এটি পুরো শরীর কালচে বেগুনি, তার উপর যখন রোদ পড়ে ঝকমক করে উঠে। ভ্যান হ্যাসল্টের মৌটুসিকে শুধু মৌটুসি ডাকা হয়, এর মাথায় পান্না রং, গায়ে বেগুনি, কালো, নীল ও লাল রং রয়েছে। সিঁদুরে মৌটুসির মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত সিঁদুরের মত লাল টকটকে রং। সিঁদুরে-হলুদ মৌটুসি সিঁদুরে মৌটুসির মত লাল, তবে পেট পুরো হলুদ, তাই এই নাম। একে বলা যেতে পারে সবচেয়ে সুন্দর মৌটুসি। আর চুনি-মুখি মৌটুসির পেট হলুদ ও পিঠ পান্না ও কলচে। মৌটুসির স্ত্রী পাখি পুরুষ পাখির মত অতটা বর্ণিল ও আকর্ষণীয় হয় না।
মৌটুসি ফুলের ভেতরে চিকন লম্বা ঠোটটি ঢুকিয়ে মধু খায়, এজন্য এই নাম। মাধু ছাড়াও ছোট পোকা মৌটুসির নিয়মিত খাবার।
৬. বামনরাঙা মাছরাঙা
বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা আছে বলে ধারণা করা হয়, প্রতিটি মাছরাঙাই অসাধারণ সুন্দর। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বামনরাঙা মাছরাঙা (Oriental Dwarf Kingfisher)। পাখিটি গাছে বসে থাকলে মনে হয় যেন বহুরঙা এটা ফুল ফুটে আছে। দেশের সবচে’ ছোট এই মাছরাঙা পাওয়া যায় সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি বনে। এবং পাখিটি বেশ বিরল, এর দেখা পাওয়া পাখিপ্রেমীদের সৌভাগ্য বলে বিবেচিত।
৫. জল ময়ূর (Pheasant tailed jacana)
নামই বলে দিচ্ছে জলাশয়ের পাখি, নেউপিপি, পদ্মপিপি বা মেওয়া নামেও পরিচিত। প্রজননকালে রং পাল্টায়, সাদার উপর কালো, খয়েরি ও সোনালির রাজকীয় রং ফুটে উঠে।
৪. কালেম
জলাশয়ের সুন্দরতম পাখি। সিলেট বিভাগ ও রাজশাহী বিভাগের জলাশয়ের পরিচিত পাখি। এনকি কেরানিগঞ্জেও এই পাখি দেখা গিয়েছে। নীলের চোখ ধাঁধানো রঙ। ইদানিং খাচায় পোষা হচ্ছে, যা পাখিটিকে বিপন্ন করবে। বাসায় পোষার চাহিদা পূরণ করতে প্রকৃতি থেকে ধরে আনতে আনতে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
প্রাপ্তবয়স্ক কালেমের (Western Swamphen) দেহের দৈর্ঘ্য ১৫-২০ ইঞ্চি এবং ওজন ৭০০-৮৫০ গ্রাম। দেহের পালক চকচকে নীলচে-বেগুনি, মাথার রং হালকা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও কপালের ওপরের লাল বর্মটি স্ত্রীর ক্ষেত্রে ছোট।
৩. সাহেব বুলবুলি
এক অদ্ভুত সুন্দর পাখি এই সাহেব বুলবুলি, একে দুধরাজ, শাহ বুলবুলি নামেও ডাকা হয়। এর লেজ অতি দীর্ঘ, ফিতার মত। এই দীর্ঘ লেজ নিয়ে বসা, উড়া প্রতিটি মুভমেন্টই দর্শনীয়। তার উপর মাথায় আছে ঝুটি। পাখিটি প্রথমে থাকে কমলা রঙে, পরে রাং পাল্টে সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায়। কাথা কালো। নারী পাখির অবশ্য লেজ বড় হয় না। ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলায় পাখিটি বেশ দেখা যায়, ঢাকায় বিরল। এর ইংরেজি নাম Indian Paradise Flycatcher. ব্লাইদের ফ্লাইক্যাচারের সাথে বেশ মিল আছে, তবে ব্লাইদের ফ্লাইক্যাচার অধিক বিরল।
২. ধনেশ
দেশে তিন প্রজাতির ধনেশ (Hornbill) রয়েছে, এর মধ্যে পাতাঠুঁটি ধনেশের বিলুপ্ত, বাকি তিন প্রজাতিই দুর্লভ ও বিপন্ন। এর মধ্যে দুটি প্রজাতি কাও ধনেশ ও রাজ ধনেশকে আমাদের তালিকায় রেখেছি। দুটো পাখিই দেখতে প্রায় কাছাকাছি, রাজ ধনেশ আকারে একটু বড়। বাস করে পাহাড়ি বনের গহিনে, উচু গাছে। শিকার ও পাচারে দেশের রাজকীয় এই পাখি বিলুপ্তির মুখে। ধনেশের ঠোঠ অনেক বড় হলেও হালকা, ভেতরটা ফাপা।
১. দেশী ময়ুর
কোনো কোনো তালিকায় ময়ুরকে বিলুপ্ত পাখি হিসেবে দেখানো হয়েছে,কারণ দীর্ঘ দিন এটি দেশের প্রকৃতিতে দেখা যায় নি। তবে সম্প্রতি প্রকৃতিতে ময়ুর দেখা গিয়েছে যদিও খুবই বিরল, যেমন পঞ্চগড়ে ২০২২ সালে দেশী ময়ুর (Indian Peafowl) এর ছবি তোলা হয়েছে। এ কারণেই পাখিটিকে এই তালিকায় আনতে পেরেছি। ময়ুরকে অস্তিত্ব থাকলে কখনও সুন্দর পাখির তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখির তালিকায় উপরে থাকবে।
একশ বছর আগে ঢাকার আশেপাশের বনেও ময়ুর ছিল প্রচুর। ময়ুরের একাধিক প্রজাতি বাংলাদেশে ছিল, সবুজ ময়ুর দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। দেশী ময়ূরের আরেক নাম নীল ময়ূর, বাংলাদেশে সংরক্ষিত ও ভারতে জাতীয় পাখি।
এই তালিকা করতে গিয়ে যাদের উপর অন্যায় করা হয়েছে: কাঠ ময়ুর, বন মোরগ, লাল মুনিয়া, বড় ভীমরাজ, চাঁদি বুক মোটাঠুটি, সিঁদুরে সাহেলি, লালপেট নীলমনি, সাদা মুকুট পেঙ্গা, লালমাথা কুচকুচি, সবুজ হাঁড়িচাঁচা, দেশি শুমচা, পানগির্দি, ঝুটিয়াল চটক, চিত্রা শালিক।
বাংলাদেশের পাখি সমন্ধে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন শরীফ খানের পুরুষ্কার প্রাপ্ত বই-
বাংলাদেশের পাখি (প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৪)- লেখক: শরীফ খান
বাংলাদেশের পাখি-প্রেমী ফটোগ্রাফাররা পাখির ছবি তুলতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি দুর্গম এলাকায় ছুটে যান। তাদের কৃতিত্বে পাওয়া কিছু ছবি এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।