ফ্লাইট নম্বর ২০৩, এমিরেটস এয়ারলাইন্স; হুমায়ূন কার্গো হোলে, সিটে গুলতেকিন ও শাওন, স্থান জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর, দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাজ্য নিউ ইয়র্ক। সময় বাংলাদেশ সময় রোববার সকাল ৯টা, একটা লাশ তুলে দেয়া হলো। কফিন চলে গেল বিমানের কার্গো হোলে। এই হল বাংলাদেশের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের শেষ দেশে ফেরা। আর ওদিকে বিমানের ভেতরে ঘটে গেল অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
হুমায়ূনের সাবেক ও বর্তমান স্ত্রী এই একই ফ্লাইট, একই পথের যাত্রী। জীবদ্দশায় এক সাথে তিনজন না হলেও আজ স্রষ্টার ইচ্ছ্বায় একই বিমানে তিনজন। তিনজন এখন তিন ভূবনের বাসিন্দা।
টমাস হার্ডি তার “টেস অফ ডারবারভিলে” নায়িকা টেসের মৃত্যুতে লেখক বলেছিলেন – অতঃপর স্রষ্টা তার খেলা শেষ করলেন। হুমায়ুনের জীবনের খেলা শেষ হলো ট্রাজেডী দিয়ে। শেক্সপিয়ারও জীবনে এতো বড় ট্রাজেডী দেখেন নি। আর এই ট্রাজেডীর মূল চরিত্র হুমায়ুন হলেও তাকে ছাপিয়ে গেলেন গুলতেকিন।
২০০৩ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি, নাম গুলতেকিন খান, খ্যাতনাম লেখক ইব্রাহিম খাঁ’র নাতনি। ১৯৭৩ সালে তার সাথে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সংসারজীবন শুরু। তখন থেকে তার নাম হয়েছিল গুলতেকিন আহমেদ।
২০০৫ সালে সংসার শুরু করা মেহের আফরোজ শাওন একই ফ্লাইট। আছেন শাওনের মা এমপি তহুর আলী, বোন সেঁজুতি, হুমায়ূনের দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত। আজ সোমবার সকাল ১০টা ২২ মিনিটে তারা হজরত শাহজালাল রহ: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের মাটি স্পর্শ করে।
হুমায়ূনের লাশ নিয়ে ফিরলেন শাওন। গুলতেকিনের আগে থেকেই এ ফ্লাইট দেশে ফেরার কথাছিলো। সে জন্য অগ্রিম টিকিট কাটা ছিল। জীবনের শেষ দিনে এসে এভাবে তারা দু’জন একই ফ্লাইট দেশে ফিরছেন।
দীর্ঘ তিন দশকের সংসার জীবনের কথা মনে গুলতেকিনের। হুমায়ূনকে হুমায়ূন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে নিভৃতে যে নারীর অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি গুলতেকিন। হুমায়ূন যাকে তার লেখায় জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন।
হুমায়ূন তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, সিনেমা বানানোর গল্প। তাতে তিনি বলেন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি বলি, গুলতেকিন, আমি সিনেমা বানাবো। সিনেমার নাম হবে আগুনের পরশমণি। সেই সিনেমা জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। সরকারের আর্থিক সহায়তায় এটি নির্মিত হয়েছিল।
অনেক স্মৃতি ভর করছে গুলতেকিনের। সাবেক স্বামীর মৃত্যুর খবর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই পেয়েছিলেন। ঢাকায় থাকেন তিনি। মেয়ে বিপাশার কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকার সময় তিনি হুমায়ূনকে দেখতে যাননি। খবর নেননি ফোনেও।
তার কাছের একজন বলেন, প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারী গুলতেকিন। অভিমানও যথেষ্ট। হুমায়ূনের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খবর রাখেননি। তবে হুমায়ূনের পরিবারের অন্যদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। হুমায়ূনের ভাই ও তাদের স্ত্রীদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। হুমায়ূনমাতা আয়েশা ফয়েজকে তিনি দেখতে যেতেন। তার খবর নিতেন। সবার কাছেই তিনি ছিলেন অনন্য।
সাবেক স্বামীর সাথে একই ফ্লাইট এলেও তার লাশ দেখতে যান নি। তবে হুমায়ূনের মৃত্যুর খবর শুনে কেঁদেছেন গুলতেকিন, ঝরঝর করে কেঁদেছেন। অনেকদিন হয়তো এভাবে কাঁদা হয়নি। এত কষ্ট হয়তো ছাড়াছাড়ির পর আর পাননি। ছাড়াছাড়ি হয়েছে ঠিকই কিন্তু এত দ্রুত হুমায়ূন পৃথিবী ছেড়ে যান তা চাননি গুলতেকিন। দূরে থেকেও তার সুখ ও শুভ কামনা করেছেন বলে ঘনিষ্ঠজনেরা বলেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের ভাই আহসান হাবীব বলেছেন, তাদের সাথে গুলতেকিনের এখনও যোগাযোগ হয়নি। হয়তো আসতে পারেন। শেষ পর্যন্ত যদি আসেন সে প্রত্যাশায় রয়েছেন সবাই।
তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, শেষ মুহূর্তের কথা বলা মুশকিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে আসার আগ পর্যন্ত তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বলেছেন, যাবেন না। কেন যাবেন? সে প্রশ্নও করেছেন। যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। শত সহস্র স্মৃতি ধরে রেখে বেঁচে থাকা কষ্ট নিয়ে। তাই তিনি যেতে চান না এমনটা তার ঘনিষ্ঠ সূত্রের। হুমায়ূন আহমেদের শেষ দেশে ফেরা।