দোহার-নবাবগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি

554

“ঠান্ডা থাকতে বাড়া বাইনা সাইরো ও সোনার বউঝি। ঢেঁকি করলে কেরুত কুরুত আড় সলইতে পানি দিবি সোনার বউ-ঝি। পার দিলে আতলা পাতলা, নষ্ট হবে ঢেঁকির কাঁতলা পরে টের পাবি সোনার বউঝি। দুই জনে মিলে এমনি ঝুমুর দিবি জমির বলে তাহলে তুই কাড়া চাল পাবি।” ঢেঁকি নিয়ে এমন গান গ্রামগঞ্জে এখন শোনা যায় না। ঢাকার দোহার-নবাবগঞ্জে ঘরে ঘরে ধান চিড়া মসলা ভাঙানোর কাজে ব্যবহৃত কাঠের তৈরি ঢেঁকির একসময় ব্যাপক ব্যবহার ছিল। আর সেই চিরচেনা ঢেঁকি এখন দোহার-নবাবগঞ্জ থেকে বিলুপ্তির পথে। যা এই অঞ্চলের ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ। আধুনিক যন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে গেছে বহুল ব্যবহৃত ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি।

খোঁজ নিলে হয়তো এখনো দোহার-নবাবগঞ্জ এর কোনো অজপাড়াগাঁয়ে এর দেখা মিলতে পারে। আমাদের দেশে এক সময় বারো মাসে তেরো পার্বণ (উৎসব) হতো। সে পার্বণে পিঠা পায়েস, সন্দেশ তৈরিতে ধুম পড়ে যেত সর্বত্র। আর তা বানাতে ব্যবহার হতো চালের গুঁড়া। চালের গুঁড়া তৈরির জন্য ঢেঁকি ছিল একমাত্র উপাদান। সে সময় ঢেঁকির ঢে কু র ঢে কু র ছন্দময় শব্দে চারপাশে অন্য এক রকম আমেজ বিরাজ করতো।

দোহার-নবাবগঞ্জের কোনো কোনো পরিবারে এখনো ঢেঁকি থাকলেও এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। অনেক সময় গ্রামের বউ-ঝিরা সারারাত ধরে ধান ভানত এবং পরের দিন তা বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন আর সেই দৃশ্য কল্পনা ছাড়া দেখা যায় না। তবে অনেক চাল ব্যবসায়ী বা বয়োজ্যেষ্ঠতা মনে করেন, ঢেঁকিতে ভাঙানো চালের কদর এখনো কমে নি। ঢেঁকিতে ভাঙা চালের রান্না করা ভাতের মজাই আলাদা। তাদের মতে, ধানকে ঢেঁকিতে দিয়ে ছাঁটলে ধানের ওপরের আবরণটি পড়ে যাওয়ায় পর পুষ্টিগুণ পুরোটাই থেকে যায়।

অন্য খবর  আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিতে নবাবগঞ্জের মরিয়ম জালাল শিমু  

ফলে ঢেঁকিতে ছাঁটানো চালের দাম মেশিনে ভাঙানো চালের চেয়ে তুলনামূলকভাবে একটু বেশি হয়ে থাকে। ঢেঁকি তৈরিতে ব্যবহার হয় মূলত গাব গাছের কাঠ এছাড়া বেল গাছ অন্য শক্ত গাছ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি হয়ে থাকে। প্রতিটি ঢেঁকি অন্তত ৫ থেকে ৬ বা ৭ ফুট লম্বা হয়ে থাকে।

একটি ৫ থেকে ৭ ফুট লম্বা মোটাকৃতির কাঠের মাথায় আরেকটি গোলাকৃতির এক হাত সমান কাঠ (সিয়া) থাকবে ও কাঁঠের মাথায় টিন বা স্টিলের গোলপাত লাগানো থাকে। ৫ বা ৭ ফুট লম্বা কাঠটি লম্বা করে। মাথার যেদিকে আরেকটি কাঠ লাগানো হয়েছে। সে দিকটি মাটির দিকে মুখ করে রাখতে হয়। ঐ লম্বা কাঠটির অপর মাথায় যে দিকে মুনাই (চুড়ানি) লাগানো হয়েছে তার বিপরীত দিকে। যে কাঠটি লম্বা কাঠটির উপরে রাখা হয় সে কাঠের দুই প্রান্তে আরো দুটি ছোট মোটা ডাল মাটিতে পুঁতে দিতে হয়। এমন রাখতে হয় যেন পা দিয়ে মুনাইর ওপর প্রান্তে চাপ দিলে সামনের অংশটি উপরে উঠে যায়। পুঁতে রাখা কাঠটি যা জিকা গাছের মোটা ডাল বা যে কোনো গাছের একটি মোটা অংশ পুঁতে হয়েছিল তার নাম কাতলা। জিকা গাছের ডাল বেশি ব্যবহৃত হতো মাটিতে এর প্রাণ ফিরে পাওয়ার কারণে।

অন্য খবর  নিজ কলেজে ভালোবাসায় সিক্ত গিয়াস উদ্দিন সোহাগ

এরপর কাঠটির উপর দিয়ে রাখা লম্বা কাঠটিকে ঘরের আড়ার সাথে অথবা মাটিতে পুঁতে একটি বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিতে হয়। পরে ঘরের পালায় ঝুলানো বাঁশের লাঠি দুই হাত দিয়ে ধরে দুইজন এক সাথে বা একজন এক পা দিয়ে লম্বা কাঠের উপরের দাঁড়ালে ঢেঁকির সামনের অংশ মাটিতে পড়বে।

আর সামনের অংশ যেখানে মাটিতে পড়বে (যাকে মুনাই বলে) ঠিক তার নিচে গর্ত করে দিতে হয় (গর্তকৃত অংশকে নোট বলে)। কারণ ধান বা চালের গুঁড়ি ঐ গর্তে রেখে কাড়াতে হয়। এইভাবেই ঢেঁকি তৈরি হয়ে থাকে। ঢেঁকিতে ধান ভানার সময় গ্রামের বউ-ঝিরা বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে থাকে।

আধুনিকতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে ঘরের বউ-ঝিরা। এখন আরাম আয়েশে থাকতে বেশি পছন্দ করে তারা। ফলে আধুনিক যন্ত্রের যুগে আমাদের আগামী প্রজন্মেও হয়তো ঘরে থাকা কম্পিউটার দিয়ে সার্স করে দেখবে বাংলার হারিয়ে ঐতিহ্যবাহী কিছু নিদর্শন। যার মধ্যে ঢেঁকিও থাকবে। জাদুঘরে সন্তানদের নিয়ে একদিন হয়তো ঢেঁকি দেখানো হবে। সেদিন আর হয়তো বেশি দূরে নয়।

আপনার মতামত দিন