নিলুফা আক্তারের স্বামী বিদেশে। দুই সন্তান নিয়ে তিনি শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন। এক সকালে বেডরুমে মিলল তার লাশ। দুই সন্তানের কান্না এবং শ্বশুর, শাশুড়ি আর দেবরের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন।
সবাই জানতে পারেন, নিলুফা আক্তার আত্মহত্যা করেছেন। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে ছিলেন। বাসার লোকজন ঝুলন্ত অবস্থা থেকে তাকে নামিয়ে আনে।
শ্বশুর-শাশুড়ির এমন কথায় লোকজন বিশ্বাস করলেও সন্দেহ ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু তারা এ নিয়ে উচ্চবাচ্চ করেননি। তাদের পরামর্শে নিলুফারকে সকালেই নেওয়া হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
থানায় মামলা হয়। ময়নাতদন্ত হয় লাশের। রিপোর্ট আসে আত্মহত্যার। পুলিশের তদন্তও একই পথে। আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় নিলুফারের শ্বশুড়বাড়ির লোকজনকে। আসামিরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে নেন। ব্যস, এটুকুই।
নিলুফারের মৃতদেহ দাফন করা হয় তার বাবার বাড়ি নবাবগঞ্জ-দোহারে। পুরো ঘটনার সমাপ্তি ঘটে।
ঘটনাটি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার। ২০১৬ সালের মে মাসের ঘটনা এটি। নিলুফার আত্মহত্যা করেছেন, এ বিষয়টি তার পরিবারের কেউ মানতে চান না। তাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। নিলুফারের দুই সন্তানের কাছ থেকেও তারা জানতে পেরেছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। মামলাটি নতুন করে তদন্ত শুরু করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
জেলা প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শম্পা ইয়াসমীনের নেতৃত্বে মামলার নতুন তদন্ত শুরু হয় ঘটনার প্রায় এক বছর পর। শ্রীনগর থানার এই মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে থানা পুলিশ। এর দুই মাস পর তদন্তের ভার পায় সিআইডি। সাত মাস তদন্ত শেষে সিআইডি প্ররোচিত আত্মহত্যার ৩০৬ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করে আদালতে।
পিবিআই তদন্তে জানতে পারে নিলুফারের স্বামী রাহাত খান বিদেশে থাকায় তিনি শ্বশুরবাড়িতেই দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন। কিন্তু কিছু দিন যাওয়ার পর রাহাতের ভাই শফিকের নজর পড়ে তার দিকে। তিনি নানাভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করতেন।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, নিলুফার দুই সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান। সেখানেই থাকতে থাকেন। কিন্তু নিলুফারের শাশুড়ির অনুরোধে তিনি আবারও ফিরে আসেন শ্বশুরবাড়ি। নিলুফারের যমজ দুই সন্তানের একজন ঘুমায় তার দাদার সঙ্গে, অন্য শিশু মুসকান ঘুমায় মায়ের সঙ্গে।
২০১৬ সালের ২৪ মে রাতে সবাই ঘুমিয়ে যায়। দেবর শফিক এই সুযোগে নিলুফারের ঘরে ঢোকেন। নিলুফার তার সন্তানকে নিয়ে তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। শফিক হঠাৎ নিলুফারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান।
শিশু সন্তান মুসকানের ঘুম ভেঙে যায়। শফিক তখন তাকে ভয় দেখায়। বলে, ‘চিত্কার করবি তো মেরে ফেলব। ’ ভয়ে চুপ করে থাকে মুসকান। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে চিৎকারের চেষ্টা করেন নিলুফার। এ সময় মুসকানও কান্না করতে থাকে।
দৌড়ে আসেন নিলুফারের শাশুড়ি। তিনি বলেন, ‘নিলুফার তো সবাইকে বলে দেবে। ’ শফিক হ্যাঁচকা টানে নিলফারকে মেঝের ওপর শুইয়ে দেন। গলা চেপে ধরেন। বালিশ নিয়ে মুখে চাপা দেন। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে নিস্তেজ হয়ে যান নিলুফার। মুসকানের সামনেই পুরো ঘটনা ঘটে।
এ সময় দৌড়ে আসেন শ্বশুর। তিনি এসেই বলেন, ‘বৌ ডারে মাইরা ফালাইলি শফিক!’ দুই সন্তান তখন কান্না করতে থাকে। এসব করতে করতেই সকাল। আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। শ্বশুর-শাশুড়ি প্রচার করতে থাকেন, নিলুফার আত্মহত্যা করেছেন।
পিবিআই কর্মকর্তারা এসব কিছু জানতে পারেন মুসকানের কাছে। পিবিআই কর্মকর্তারা দেখতে পান, পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনেও গরমিল রয়েছে। যে ছবি পুলিশ দিয়েছে তাতে দেখা যায়, লাশের শরীরে কিছু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়নি।
পিবিআই কর্মকর্তারা তখন নবাবগঞ্জ-দোহারে ছুটে যায়। নিলুফারের মৃতদেহ যারা গোসল করিয়েছেন, তাদের খোঁজ করতে থাকেন। তারা জানতে পারবেন, শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল কিনা। এমন তিন মহিলাকে খুঁজে পান পিবিআই কর্মকর্তারা।
ওই তিন মহিলা তাদের জানিয়েছেন, নিলুফারের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন ছিল। ধস্তাধস্তির পর যেমন আঁচড় পড়তে পারে, ঠিক তেমনি আঁচড় ছিল নিলুফারের শরীরে। পুলিশ নিশ্চিত হয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। লাশ গোসলেই খুলে যায় নিলুফার খুনের রহস্য। পিবিআই পরে শফিক ও তার মায়ের বিরুদ্ধে আদালতে ৩০২ ধারায় চার্জশিট দাখিল করে। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।