মেহেরপুর সদর উপজেলার উজ্জলপুর গ্রামের টিউবয়েলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল গ্রামটির প্রতিটি টিউবয়েলে লাল চিহ্ন দিয়ে পানিপানে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে গত দেড়যুগ আগে। গ্রামের এক প্রান্তে সেভ দি চিলড্রেণ আর্সেনিকমুক্ত পানির রিমুভ্যাল প্লান্ট স্থাপন করেছে। সেখান থেকে গ্রামের মানুষকে অর্থের বিনিময়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হয়। গ্রামের দুস্থ পরিবারগুলো সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারেনা। গ্রামের মানুষকে সুপেয় পানি দিতে ওই গ্রামেরই এক যুবক মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক দূর করার কাজে ফিল্টার আবিস্কার করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এখন গ্রামের মানুষ তার বাড়ি থেকে আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সংগ্রহ করছে। মৃত লুৎফর রহমান এর ছেলে মোমিনুল ইসলাম এ প্লান্ট আবিস্কার করায় তাকে এখন সকলেই সমীহ করে।
সরেজমিনে উজ্জলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় গ্রামের নারী পুরুষ সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছে। মোমিনুল জানায়- প্রটোটাইপটি তৈরি করতে একটি টিনের ড্রাম আর ড্রামের মাঝখানে একটি ফিল্টার বসানো হয়েছে। তবে এতে বিদ্যুৎ ও কেমিক্যালের ব্যবহার করা হয়নি। মর্ধাকর্ষণ শক্তিকে কৃত্রিম শক্তিতে রূপান্তর করে কাজ করা হয় ফিল্টারটিতে। ফিল্টারের মধ্যে বালি ও কাঠ কয়লা নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার আছে। ফিল্টারেশনের কারণে পানিতে যে ময়লা জমা হয় তা একটি পাইপের মাধ্যমে উপর দিয়ে বের হয়ে ডাস্ট পটে জমা হয়। তার পাশেই রয়েছে নিরাপদ পানি বের হওয়ার পাইপ। যার মাথাই দুটি সুইচ ব্যবহার করা হয়েছে। সুইচের মাধ্যমে পানির প্রবাহকে বাড়ানো কমানো যায়। আর্সেনিকের পাশাপাশি আয়রন ম্যঙ্গানিজ, টারবেডিটি, রং দুর্গন্ধসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান ও ব্যাক্টেরিয়া দূর করতে সক্ষম ফিল্টারটি। আবিস্কৃত এই যন্ত্রে প্রতিদিন ৮০ লিটার পানি ফিল্টার করতে সক্ষম। কিন্তু আর্থিক সংকটে সে বৃহৎ আকারে কাজ শুরু করতে পারছে না। বৃহৎ আকারে কাজ শুরু করলে সাকুল্যে ৪শ টাকা খরচ করে এ প্লান্ট বাজারজাত সম্ভব বলে আশা করছেন মোমিনুল।
২০০৬ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ গ্রামটিতে নলকূপের পানি পরীক্ষা করে অতিরিক্ত আর্সেনিকের কারণে ভূগর্ভস্থ থেকে টিউবয়েলে তোলা পানিপানে নিষেধ করে। এসময় মোমিনুল পেপসির বোতল আর মাটির কলসে আর্সেনিক ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বানিয়ে খেলা করে। মোমিনুল ২০১৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে গ্রামে ফিরে আসে। এসময় গ্রামের মানুষকে সুপেয় পানি দিতে গবেষণা শুরু করে। ফলপ্রসু হতে তার তিনবছর সময় লাগে। ইতোমধ্যে মেহেরপুর সদর উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মাকবুলার রহমানের সহায়তায় উদ্ভাবকের প্রতিবেশীর অগভির নলকূপ ও প্রোটাইপের পানির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ঝিনাইদহ জেলার আঞ্চলিক পানি গবেষণাগারে ওই পানির পরীক্ষা করা হলে আশাব্যঞ্চক ফল পাওয়া যায়। নলকূপের পানিতে ০.২১৮ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে আর্সেনিক পাওয়া গেলেও প্রটোটাইপে পাওয়া যায় ০.০১ মিলিগ্রাম পরে ওই আঞ্চলিক পানি গবেষণা কেন্দ্রে উদ্ভাবকের নলকূপের পানি ও প্রটোটাইপ ফিল্টারের পানি পরীক্ষা করে। নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ০.৩৯৬ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৩.০৬ মিলিগ্রাম, ম্যঙ্গানিজ ১.০২ মিলি গ্রাম পাওয়া যায়। অথচ ফিল্টার করার পরে ওই পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ০.০৬৯ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৭৪ মিলিগ্রাম, ম্যঙ্গানিজ ০.০৫ মিলি গ্রাম পাওয়া যায় । পরবর্তীতে প্রটোটাইপটি কিছুটা উন্নত করা হলে ওই আর্সেনিকের মাত্রা ০.৩৯৬ থেকে ০.০০৯ মিলিগ্রাম, আয়রন ১৩.০৬ থেকে ০.০০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায় । কিছুদিন পর অন্য প্রতিবেশী মোঃ মোস্তাকিন শাহ্ এর নলকূপের পানি ও উক্ত পানি ফিল্টার করে পরীক্ষা করা হয়। এতে আর্সেনিকের মাত্রা আসে ০.১৮১ মিলিগ্রাম থেকে ০.০০৭ মিলিগ্রাম পাওয়া যায় । জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঝিনাইদহ জেলার আঞ্চলিক পানি গবেষণা কেন্দ্রের জুনিয়র কেমিস্ট কানাই লাল দাস ও নজরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত টেস্ট রিপোর্ট থেকে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
মেহেরপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল গফুর মোল্লা জানান, হাউজহোল্ড ফিল্টার ও কৃত্তিম কূপটি যথাযথভাবে মূল্যায়ণ করা দরকার। বাজারে যে সব ফিল্টার পাওয়া যায় সেগুলো আয়রন ফিল্টার করতে পারলেও আর্সেনিক ফিল্টারে কার্যকরী নয়। মোমিনুলের ফিল্টারটি বাজারজাত হলে ভুক্তভোগীরা ব্যবহার করে নিরাপদ পানি পেতে পারেন।