বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। আয়োজন সফল করতে অনুষ্ঠান এলাকায় প্রস্তুতিও প্রায় শেষ করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) রাতে সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির দফায় দফায় বৈঠক ও নানা নাটকীয়তার পর গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) শহীদ মিনারে পূর্ব-ঘোষিত ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেয়া হবে না বলেও জানানো হয়। তবে, মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি যোগ দিতে সারাদেশের ছাত্র জনতা ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনুরোধ করা হয়।
গভীর রাতে কর্মসূচি ঘোষণার কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জেলাগুলো থেকে মানুষজন কিছুটা দেরিতে রওনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
মঙ্গলবার সকাল থেকে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, নাটোর, নওগা, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলা থেকে গাড়ি নিয়ে শহীদ মিনার এলাকায় আসতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। তাদের কোনো কোনো দলকে ঘটনাস্থলেই অবস্থান নিতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলেও তাৎক্ষণিক ভাবে অবস্থান নিয়েছেন।
এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
প্রস্তুতি ও শহীদ মিনার এলাকা
এর আগে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়ার পর মধ্যরাত থেকেই শহীদ মিনার এলাকায় পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। সোমবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয় এই কর্মসূচিতে সারাদেশের দেড় থেকে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের সমাগম হবে। যে কারণে বিশাল এ আয়োজনের জন্য সাউন্ড সিস্টেম প্রস্তুতির কাজ শুরু হয় সোমবার সন্ধ্যা থেকেই।
মঙ্গলবার সকাল থেকে শহীদ মিনার এলাকায় চুড়ান্তভাবে সাউন্ড চেকিং, ক্যামেরা স্থাপন, ডিজিটাল মনিটর স্থাপনের কাজ চুড়ান্ত করতে দেখা গেছে। সকালের পর্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে কিছু প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হবে। যে কারণে বিভিন্ন জায়গায় বড় পর্দাও স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলোর প্রস্ততিও নিতে দেখা যায় আয়োজক শিক্ষার্থীদের।
মঙ্গলবার ভোরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকেএকটি ভিডিও আপলোড করা হয়। শহীদ মিনারের কর্মসূচি ঘিরে শিক্ষার্থীদের ব্যানার ফেস্টুন আর পতাকা নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখা যায়। ‘মুজিববাদ নিপাত যাক’, ‘দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা-ঢাক’, ‘বিপ্লবীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না’, আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ এমন নানা প্লাকার্ড তৈরি করতেও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।
জড়ো হতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা
গত রাতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রওনা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো শিক্ষার্থীরা আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংলগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলোতে গিয়েছেন। সকাল নয়টার মধ্যে বেশিরভাগ বাসই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে।
শুধুমাত্র যেসব বাসে আহত কিংবা অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা আসবে সেসব বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকতে পারবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, বাকি বাসগুলো থাকবে শেরে বাংলা নগরের পুরাতন বাণিজ্য মেলা এলাকায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য সচিব তৌহিদ হোসেন সিয়াম জানিয়েছেন, তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুপুর ১২টায় রওনা দেবে বেশ কয়েকটি বাস। এছাড়া ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে সকালেই এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসবেন শিক্ষার্থীরা।
ডিএমপির নির্দেশনা
শহীদ মিনারকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যানবাহনগুলোর জন্য নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ডিএমপি। সোমবার সন্ধ্যায় ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান তিনটি নির্দেশনার কথা জানান।
১. গাবতলী হয়ে ঢাকা মহানগরে প্রবেশ করা যানবাহনগুলো মানিক মিয়া এভিনিউ ও আগারগাঁও এলাকার পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠে পার্কিং করবে।
২. সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী দিয়ে প্রবেশ করা যানবাহনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় পার্কিং করা যাবে।
৩. আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রবেশ করা যানবাহনগুলো ৩০০ ফিট এলাকায় পার্কিং করবে।
ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান ঢাকা মহানগর এলাকা যানজটমুক্ত রাখতে এবং সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে আসা সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।
যেভাবে ‘মার্চ ফর ইউনিটি‘ ঘোষণা
শনিবার বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেয়ার কর্মসূচির আভাস দেন। পরদিন রবিবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেন, ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘দেশে মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে’, এবং ‘আওয়ামী লীগ দল হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়বে বাংলাদেশে। বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
এর এক পর্যায়ে রবিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তরফ থেকে বলা হয়, ৩১শে ডিসেম্বরের কর্মসূচি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’, যা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
পরে সোমবার রাতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। এরপর শহীদ মিনারের কর্মসূচি বহাল রাখা হবে কী-না তা নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। দফায় দফায় বৈঠক আর সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা আসে রাতে।
রাত প্রায় পৌনে দুইটায় জানানো হয়, মঙ্গলবার পূর্বঘোষিত ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর পরিবর্তে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় সংগঠনটি।
মধ্যরাতের ওই প্রেস ব্রিফিংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, সাবেক সমন্বয়ক সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ের শুরুতে সারজিস আলম বলেন, আমাদের ‘প্রক্লেমেশন অফ জুলাই রেভ্যুলেশনে’র ডিমান্ডকে ধারণ করে সকলকে ঐক্যবদ্ধ একটি জায়গায় এনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্রটি আসা উচিত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টি অনুভব করেছে। এটি একটি লিখিত ডকুমেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসা উচিত। রাষ্ট্র যখন দায়িত্ব নিয়ে নেয় তখন আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাই।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তিনি বলেন, এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের ঐতিহাসিক দায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর বর্তায়। নানা প্রতিকূতলা সত্ত্বেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র প্রণয়ন ও ঘোষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে স্বতস্ফূর্ত ইতিবাচক সাড়া সঞ্চারিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার বেলা তিনটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো।