নবাবগঞ্জের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের ভাঙা মসজিদ

3871
ভাঙা মসজিদ

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভাঙা মসজিদ । প্রায় ৫০ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি। তবে মূল ভবন রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ জমির ওপর। মসজিদটিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও নামাজের আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদটিতে এবাদত করতে প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে নবাবগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি থানার কয়েক হাজার নারী-পুরুষ নামাজির সমাগম হয়। কাছাকাছি হওয়ায় পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ থেকেও কখনও মুসল্লি আসেন।

ধারণা করা হয়, তিন গম্বুজবিশিষ্ট ‘ ভাঙা মসজিদ ’ সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত। সে হিসাবে প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো মসজিদটি নবাবগঞ্জের কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ১৬৫ ফুট সুউচ্চ একটি মিনার। মিনারটি ঢাকা দক্ষিণের সবচেয়ে বড় মিনার বলে জানা গেছে।

লোকমুখে প্রচলিত, ষোলোশ’ শতকে দিল্লি থেকে নদীপথে ঢাকা যাতায়াত করতেন মোগল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি। তিনি নৌবহর নিয়ে যমুনা নদী হয়ে পাবনা ও মানিকগঞ্জ অংশে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ইছামতী নদী দিয়ে ঢাকা আসতেন। রাতযাপন ও ইবাদত করার জন্য আনুমানিক ১৬১৫ সালে নদীর পাশেই মসজিদটি নির্মাণ করেন তিনি।

কালের পরিবর্তনে ইছামতী নদী ভাঙতে ভাঙতে উত্তরদিকে চলে যায়। উল্লেখ্য, ১৬১০ সালে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবেদার ছিলেন ইসলাম খান চিশতি

নির্মাণের সময় মসজিদের পাশে কোনো বসতি ছিল না। পুরো এলাকা ছিল বনাঞ্চল। ১৮৮০ সালে হিন্দু জমিদাররা ওইসব বনাঞ্চল পত্তন নেন। তখন সেখানে বসতি স্থাপন করার জন্য বনাঞ্চল কাটা আরম্ভ করে হিন্দুরা। বন কাটতে গিয়ে নজরে আসে এই মসজিদটি। যার ওপরের কিছু অংশ ভাঙা ছিল। সেই থেকেই এই মসজিদের নাম হয় ‘ভাঙা মসজিদ’ বা ‘গায়েবি মসজিদ’।

অন্য খবর  জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সভা

সময়ের বিবর্তনে এক পর্যায়ে মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেন স্থানীয় আলফু ফকির, দুদু মীর, আবেদালি মীর, গোপাল মাদবর, মৈজদ্দিন সিকদার, গহের আলী খন্দকারসহ স্থানীয়রা। আবু মোল্লাকে মসজিদের মাতোয়াল্লি বা সেবায়েত নিযুক্ত করা হয়। সিএস রেকর্ডে মসজিদের পক্ষে তার নামই রয়েছে।

১৯৪৫ সালে স্থানীয় আবেদ আলী নিজ অর্থায়নে কিছু অংশ সংস্কার করেন। তখন মসজিদের সেবায়াত হিসেবে দুখাই বেপারিকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৬০ সালে নতুন বান্দুরা পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ হিসেবে আসেন আবজাল হোসেন নামে এক ধর্মপ্রাণ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙা মসজিদটির কিছু মেরামত এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয় ডা. আলমাছ উদ্দিনকে। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মকবুল বেপারি ও কদম আলীকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ওই কমিটি প্রায় ২০ বছর দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮০ সালে স্থানীয় আমজাদ হোসেন মাদবর গ্রামবাসীকে নিয়ে মসজিদের নতুন কমিটি গঠন করে দায়িত্ব বুঝে নেন।

দায়িত্ব নেওয়ার পরই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। তখন মূল ভবনের সংস্কার করলেও তার অবকাঠামোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। পরে আমজাদ হোসেন মাতবরের ছোট ছেলে কুয়েত প্রবাসী নজরুল ইসলামের চেষ্টায় বিদেশের অর্থায়নে মসজিদ সংলগ্ন আরেকটি ভবন তৈরি করা হয়।

অন্য খবর  গালিমপুরে তুচ্ছ ঘটনায় হামলা; আহত ৩

২০০১ সালে মীর সফিউদ্দিন ও আলী সিকদারকে উপদেষ্টা হিসেবে রেখে খন্দকার ফুরহাদ হোসেনকে সভাপতি, মতিয়ার রহমানকে সাধারণ সম্পাদক ও ফজলুর রহমানকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।

নতুন কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি মিনার নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। প্রাথমিকভাবে কাজ আরম্ভ করে মাটির নিচে প্রায় ৬০ ফুট বোরিং করে রডের খাঁচা বাঁধিয়া ৬০ ফুট ঢালাইয়ের ওপর ১৪টি পিলার নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ই এতে তাদের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৭ লাখ টাকা। কিছুদিন কাজ করার পর রাজমিস্ত্রি ও আনুষঙ্গিক অসুবিধার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

দীর্ঘ বিরতির পর ২০১১ সালের ৪ মার্চ আবার মিনারের কাজ আরম্ভ হয়। ১৬৫ ফুট উচ্চতা মিনারটি কাজ এখন সমাপ্তির পথে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে বলে জানায় মসজিদ কমিটি।

প্রায় ৩০ বছর ধরে মসজিদের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকারী মো. ফজলুর রহমান জানান, মসজিদে আগত মুসল্লিদের দানে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় হয়। সেই টাকা দিয়েই কোটি টাকা ব্যয়ে মিনার নির্মাণ করা হচ্ছে।

আপনার মতামত দিন