ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা? নব্বইয়ের দশকে আমাদের যাদের বেড়ে ওঠা তাদের জন্য ‘রাতে কী দিয়ে ভাত খেয়েছ?’ আর ‘বার্ষিক পরীক্ষায় এবার কততম হয়েছ?’ প্রশ্নগুলোর মতো আপন এটা। তফাৎ একটাই, এ প্রশ্নটা শুনতে হত চার বছর পর পর। বংশ পরম্পরায় সমর্থন জুটেছে কারও, কেউ কেউ ‘বংশ বৈরিতায়’ অন্য কিছু বেছে নিয়েছেন। কিন্ত রীতিটা আমরা বদলাতে দেইনি। পেলে-ম্যারাডোনা, রোনালদো-বাতিস্তুতা থেকে মেসি-নেইমার পর্যন্ত রেষারেষি টেনে এনে এখনও চলছে আমাদের ফুটবল দর্শন! আপনি হয়ত ভাবতে পারেন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে মাতামাতিটা বোধ বাংলাদেশেই বেশি। সেটা ভেবে থাকলে নির্দয় হয়ে আপনাকে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার প্রতিদ্বন্দ্বীতা ফুটবল ইতিহাসের অংশ, সম্ভবত ফুটবলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ম্যাচ। আপনি যে দলের সমর্থনই হোন না কেন, ফুটবল নিয়ে আপনার আগ্রহ যতই কম থাক না কেন- এই ম্যাচ নিয়ে বাড়তি উন্মাদনা উপেক্ষা করার মতো সামর্থ্য থাকলে এই লেখা হয়ত আপনার জন্য নয়।
এই দুইদলের প্রীতি ম্যাচও উত্তেজনার রেনু ছড়ায় পুরো বিশ্বে। প্রতি চার বছরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দুইবার করে দেখা হয় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার। এছাড়া বড় টুর্নামেন্টে দুইদলের ম্যাচ পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। এবার যেমন কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে খেলতে যাচ্ছে দুইদল। সেটাও ১২ বছর পর! মাঝে পার হয়ে গেছে একযুগ। তাতে একটা প্রজন্মই হারিয়ে গেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার। ২০০৭ সালে ভেনেজুয়েলার কোপাতে ফাইনালে সবশেষ দেখা হয়েছিল দুইদলের। একপেশে ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ব্রাজিল সেবার জিতেছিল নিজেদের অষ্টম শিরোপা। তখনকার দুই দলের মোট ৪৬ জনের স্কোয়াডের মাত্র দুইজন খেলোয়াড় আছেন এখন। তারা দুইজন এখন দুইদলের অধিনায়ক। বার্সেলোনায় একসঙ্গে ৭ বছর খেলার সুবাদে তারা খুব ভালো বন্ধুও। ব্রাজিলের দানি আলভেজ ও আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি।
সেবার আলভেজের বয়স ছিল ২৩। ফাইনালে একাদশে ছিলেন না তিনি। এলানো ইনজুরিতে পড়ার পর ৩০ মিনিটে মাঠে নেমেছিলেন আলভেজ। এরপর গোলও করেছিলেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালে। আর সেবারের কোপা থেকেই ১৯ বছর বয়সী মেসি নিয়মিত হয়েছিলেন আর্জেন্টিনা দলে। গ্রুপপর্ব, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালে দুর্দান্ত খেলেছিলেন, কিন্তু ফাইনালে গিয়ে তাকে হার মানতে হয়েছিল ব্রাজিলের কাছে। এরপর মেসি আরও তিনবার জাতীয় দলের হয়ে ফাইনাল খেলেছেন, কিন্তু ভাগ্যটা বদলাতে পারেননি। আর আলভেজ এরপর ব্রাজিলের হয়ে দুইবার জিতেছেন কনফেডারেনস কাপের শিরোপা।
হিসাব মতে অবশ্য সেমিফাইনালে এবার দেখা হওয়ার সুযোগ কমই ছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার। ব্রাজিল হিসাব মতো এগুলেও গ্রুপপর্বে আর্জেন্টিনা রানার্স আপ হওয়ায় দেখাটা হয়ে যাচ্ছে সেমিফাইনালেই। স্বাগতিক দেশ, তারওপর আর্জেন্টিনার নড়বড়ে অবস্থা- সবমিলিয়ে এই টাইয়ে ব্রাজিলই ফেভারিট। ইতিহাসও তেমনটাই বলছে, ব্রাজিলের মাঠে কোপা আমেরিকাতে কখনই ব্রাজিলকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ১৯১৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত মোট ৬ বার স্বাগতিক হিসেবে ব্রাজিল কোপা আমেরিকায় খেলেছে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। এর মধ্যে আর্জেন্টিনার সেরা সাফল্য ১৯৮৩ সালে একটি গোলশূন্য ড্র। ৬ ম্যাচে আর্জেন্টিনা গোল করতে পেরেছে তিন দফায় মোট তিনটি।
স্বাগতিকের হিসাব বাদ দিলে অবশ্য দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে আছে আর্জেন্টিনা। কোপায় ১৫ বার জয়ী আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ৯ বার। বাকি ৮ বার ম্যাচ হয়েছে ড্র। আর সবমিলিয়ে হিসাব করলে মোট ১১০ বার একে অপরের বিপরীতে খেলেছে দুইদল। ১৯১৪ সালে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে শুরু। প্রথম ম্যাচটা আর্জেন্টিনা জিতে নিয়েছিল ৩-০ গোলে। এরপর অনেকদিন আর্জেন্টিনা হেড টু হেডে এগিয়ে থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিলই এক চেটিয়া আধিপত্য দেখিয়েছে। ১১০ ম্যাচে ব্রাজিলের জয় ৪০ আর আর্জেন্টিনার ৩৮।
এবারের সেমিফাইনালের মাহাত্ম্যটা আরও একদিক দিয়ে বাড়তি উন্মাদনা চড়িয়ে দিচ্ছে দুইদলের সমর্থকদের। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা আর কনফেডারেশনস কাপ মিলিয়ে দুই দলের শিরোপা ১৭টি করে। সেমিফাইনালে জয়ী দল নিজেদের শিরোপা সংখ্যা বাড়িয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার সুযোগটাও পেয়ে যাবে এবার। আর একটা ব্যাপার নিশ্চিতভাবেই বদলে যাচ্ছে এবার। ১৯৯৩ সাল থেকে কোপা নতুন ফরম্যাট চালু হওয়ার পর ৫ বার করে সেমিফাইনাল খেলেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুইদলই। প্রতিবারই দুইদল উঠেছে ফাইনালে। এবার সেই রেকর্ডে ছেদ পড়বে যে কোন এক দলের।
গত বছরই সবশেষ দুইদল খেলেছিল প্রীতি ম্যাচে। সেখানেও ব্রাজিল জিতেছিল ১-০ ব্যবধানে। আর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ বাদ দিলে (স্বাগতিক হওয়ায় সরাসরি খেলেছিল ব্রাজিল) ২০১০ ও ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের মোট চার ম্যাচেও ব্রাজিলকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয় খুঁজতে আপনাকে ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে চলে যেতে হবে ২০০৫ সালে। নিজেদের মাঠে সেবার আর্জেন্টিনা সেলেসাওদের হারিয়েছিল ৩-১ ব্যবধানে।
তবে সেমিফাইনালের ভেন্যুটা ব্রাজিলের জন্য পয়া নয় মোটেই। এই মাঠেই ২০১৪ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেই জার্মানির মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল। পরের গল্পটা নতুন করে আরেকবার বলে সেলেসাও ভক্তদের রক্তক্ষরণটা আর নাই বা বাড়ালাম। আর্জেন্টিনা অবশ্য আড়ালে স্বস্তি খুঁজতে পারে সংস্কার, কুসংস্কারের বুলি আওড়ে। ব্রাজিলের কাছে তো স্বাগতিক হওয়াটা চাপেরও।
ইতিহাসের পাতা উলটে আপনি ফেভারিট বা আন্ডারডগ খুঁজে বের করতে পারেন। চাইলেই নিজের দলকে এগিয়ে রাখতে পারেন নিজের ইচ্ছেমতো যুক্তি সাজিয়ে। অথবা তর্কযুদ্ধেও নেমে যেতে পারেন। কিন্তু এসব কিছুই ধোপে টিকবে না ৩ জুলাই। ঘুম থেকে উঠে বা না ঘুমিয়ে কাক ডাকা ভোরে টিভি অন করে রেফারির কিক অফের বাঁশির সঙ্গে আপনার বুকেও দুরুদুরু কাপনটাও শুরু হয়ে যাবে। তার আগে কয়েকদিন ধরে চলবে আলোচনা, তর্ক। ম্যাচশেষেও থামবে না সেসব। আগের রাতে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ভাগ্যে যাই থাকুক না কেন, আরও একবার উৎসবে মাততে অথবা আরেকটু মন খারাপ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে আপনিও মিশে যাবেন কয়েক শ ক্রোশ দূরে মিনেইরোতে। একটি ফুটবল ম্যাচে। মেসি-আলভেজদের সঙ্গে।