বাংলাদেশি জাহাজ ভাঙার একটি ওয়ার্কশপে মোহাম্মদ ইদ্রিসের জীবন শেষ হয়ে যায় ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল, শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায়। ৩৮ বছরের এই কাতুরি (লোহা কাটার শ্রমিক) কাজ করছিলেন শতাধিক শ্রমিকের সঙ্গে। চট্টগ্রামে ফেরদৌস স্টিল করপোরেশনের শিপইয়ার্ডে তারা কাজ করছিলেন ১৯ হাজার ৬০০ টনের কনটেইনার জাহাজ ইউরোস লন্ডন-এ। এমন সময়েই তার জীবনের ভয়াবহ বিপর্যয়টি সংঘটিত হয়।
ইদ্রিসের কাজ ছিল আগুনের শিখা (ব্লো টর্চ) দিয়ে ৪০ টনের প্রপেলার কেটে ফেলা। কাদায় প্রপেলারের পতন ঠেকাতে সেখানে বড় ধরনের একটি লোহার পাটাতন তৈরি করা হয়। এটা দেখেই ইদ্রিসের মনে আশঙ্কা জাগে। তিনি বলেন, আমি সুপারভাইজরসহ আরও দু’জনকে বলি, এটা বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ যখন প্রপেলারটি নিচের দিকে পড়তে শুরু করবে, তখন তা লোহার পাটাতনে পড়ে লাফিয়ে ওপর দিকে উঠতে পারে।
কিন্তু তাকে নির্দেশ মেনে কাজ করতে হয়েছে এবং প্রায় মারা যাচ্ছিলেন। প্রপেলারটি কাটার পর মুক্ত হয়ে লোহার পাটাতনে ধাক্কা খেয়ে তার আশঙ্কা মতোই ওপর দিকে উঠে যায়। হাঁটুর নিচে তার পা কেটে ফেলে, একটি চোখ অন্ধ হয় এবং তার পিঠ প্রায় ভেঙে যায়।
কোম্পানির পক্ষ থেকে হাসপাতালের খরচ বহন করা হয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া দুর্ঘটনার পর ৯ মাস প্রতি সপ্তাহে তাকে ৪৬০ টাকা করে দেওয়া হয়। যে সাত সদস্যের পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী মানুষ ছিলেন ইদ্রিস, সেই পরিবারকে বন্ধু ও স্বজনদের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ায় ইউরোস লন্ডন জাহাজটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা লন্ডনভিত্তিক জাহাজ কোম্পানি জোডিয়াক ম্যারিটাইমকে দায়ী করা যেত।
এভাবে প্রতিবছর জাহাজ ভাঙার কাজে দুর্ঘটনায় অনেক বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি নিহতের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ, আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান জাহাজ মালিক ও ব্যবস্থাপককে দায়ী করা যেত। ইদ্রিসের পক্ষ হয়ে যুক্তরাজ্যের আইনি প্রতিষ্ঠান লেই ডে অবহেলার জন্য জোডিয়াকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। লেই ডে’র দাবি, ইসরায়েলি জাহাজব্যবসায়ী স্যামি অফারের ছেলে ইয়াল অফার জোডিয়াক কোম্পানির মালিক এবং কোম্পানিটি দেড় শতাধিক বড় জাহাজের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত। তারা যখন নগদে বা মধ্যস্বত্বভোগী মার্কিন কোম্পানি জিএমএস-এর কাছে জাহাজ করে তাদের জানা উচিত চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা কতটা বিপজ্জনক।
লেই ডে প্রতিষ্ঠানের এক পরিচালক মার্টিন ডে বলেন, জোডিয়াক জানে অথবা তাদের জানা উচিত যে, নগদে ক্রেতার মাধ্যমে যখন তারা চট্টগ্রামের কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে জাহাজ বিক্রি করে, সেখানে যারা কাজ করে, তারা শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
পরিবেশবাদী ও ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নতুন আইনি পদক্ষেপ প্রয়োজন। কারণ শ্রমিকদের মৃত্যু ও আহত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছেই।
দুর্ঘটনায় পা হারানো আহত জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ইদ্রিস। ছবি-গার্ডিয়ান
এক হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে ‘সবুজবান্ধব’ নবায়নযোগ্য শিল্প হচ্ছে জাহাজ ভাঙা। এতে প্রতিটি নাট, বল্টু ও লোহার শিটকে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হয়। বিশ্বের কয়েকটি দরিদ্র দেশের কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয় এই খাতে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, জাহাজ মালিকরা শ্রমিকদের দুর্ভোগ হবে জেনেও এশিয়ার সৈকতে জাহাজ ভাঙার জন্য পাঠাচ্ছে। গত দুই বছরে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ২৮টি জাহাজ পাঠিয়েছে এশিয়ায়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে ছয়টি। গত সপ্তাহেই জোডিয়াকের ব্যবস্থাপনায় ভাঙার জন্য অপেক্ষায় ছিল দু’টি জাহাজ।
ব্রাসেলসভিত্তিক পরিবেশবাদী, মানবাধিকার ও শ্রমিক সংগটনের জোট শিপব্রেকিং প্লাটফর্মের পরিচালক ইংভিল্ড জেনসেন বলেন, নগদ অর্থে জাহাজ বিক্রি করে জাহাজ মালিকরা দায় গ্রহণ থেকে নিজেদের রক্ষা করছে। পুরনো জাহাজের ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ দাম প্রস্তাবকারীর কাছে জাহাজ বিক্রি করে দেয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে যেসব জাহাজ পৌঁছায়, সেগুলো নগদ ক্রেতাদের মাধ্যমেই যায়। আর নগদে ক্রেতারা সর্বোচ্চ দাম প্রস্তাবকারীর কাছে বিক্রি করে দেয়।
জেনসেন জানান, প্রতিবছর আট শতাদিক জাহাজ এশিয়ায় ভাঙা হয়। জাহাজের মালিকরা এশিয়ার শিপ ইয়ার্ডে নগদ ক্রেতাদের মাধ্যমে বিক্রির ফলে ১০ থেকে ৪০ লাখ ডলার বেশি মুনাফা করে। যদি উচ্চমানের শিপ ইয়ার্ডে তা বিক্রি হতো তাহলে এই অতিরিক্ত মুনাফা তারা পেতো না। তিনি বলেন, কেউ তাদের সেখানে (এশিয়া) জাহাজ পাঠাতে বাধ্য করেনি। তারাই এসব জায়গা নির্বাচন করে।
ইদ্রিস ১৪ বছর বয়সে চট্টগ্রামে আসেন। দুর্ঘটনায় পড়ার আগ পর্যন্ত সপ্তাহে ছয়দিন ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করতেন। প্রতিদিন তার আয় হতো প্রায় সাড়ে তিনশ টাকা। ১৯৬০ সালের দিকে শুরু হওয়া জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করা কয়েক হাজার শ্রমিকের মধ্যে একজন তিনি। দুর্ঘটনায় নিহতদের সরকারি কোনও তথ্য নেই। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, গত দশ বছরে ১২৫ জনের বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রাম এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ ভাঙার স্থান। গত বছর এখানে ২৩০টি জাহাজ ভেঙে রিসাইকেল করা হয়েছে। এতে প্রায় ১ কোটি টন স্টিল পাওয়া গেছে। এসব স্টিলের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়। এখানে কাজ করা শ্রমিকদের বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা। ইয়ার্ডের পাশে অতিরিক্ত মানুষের সঙ্গে বাস করে তারা। ফেরদৌস ইয়ার্ডের মতো এগুলোর অবস্থা প্রায় এক। হাতুড়ি ও লোহা কাটার দিয়ে বড় ধরনের একটি জাহাজ ভাঙতে তরুণদের প্রায় একমাস লেগে যায়।
বাংলাদেশে শিপব্রেকিং প্লাটফর্মের সমন্বয়কারী মুহাম্মদ আলী শাহীন বলেন, চট্টগ্রামে সবচেয়ে সস্তায় জাহাজ ভাঙা হয় কিন্তু মূল্য দিতে হয় দুর্ভোগ শিকার করে। এ বছর ৯জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব মানুষের জীবনের জন্য কেউ দায় নিতে রাজি নয়। আইনে তেমন কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এশিয়ায় জাহাজ ভাঙা নিষিদ্ধ করেছে আইন করে। কিন্তু মালিকরা সহজেই জাহাজের মালিকানার দেশ পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।
শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা সংস্থা ২০০৯ সালে হংকং কনভেনশন (এইচকেসি) পাস করেছে। এইচকেসি অনুসারে, কোনও জাহাজ মালিক বা দেশ মানুষের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু শিপব্রেকিং প্লাটফর্মের মতে, এইচকেসি কার্যকর হচ্ছে না। কারণ এই নিয়ম বাস্তবায়ন করার জন্য ১৫ দেশ ও বিশ্বের জাহাজ মালিকদের ৪০ শতাংশকে এতে স্বাক্ষর করতে হবে।
জিএমএস কোম্পানি অ-নির্বাহী পরিচালক নিকোস মিকেলিস বলেন, হংকং মান ধীরে ধীরে এই খাতে গ্রহণ করা হচ্ছে। আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে কনভেনশনটি কার্যকর হতে পারে। অনুস্বাক্ষর ও এইচকেসির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে না।
নিকোস দাবি করেন, শিপব্রেকিং প্লাটফর্ম শিশু সুলভ এবং তারা জাহাজ ভাঙা শিল্পের বাতিল চায়। যা কয়েকটি দরিদ্র দেশে কয়েক হাজার শ্রমিকের জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
জিএমএস’র এই কর্মকর্তা পরিস্থিতির উন্নতি দেখছেন। তিনি বলেন, ভারত ও জাপান এই খাতের উন্নয়নের জন্য ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। ভারত ও জাপানের ১২০টি ইয়ার্ড এইচকেসির মান সম্পন্ন এবং আরও ১৫টি নিরাপদ কাজের পরিবেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র একটি কোম্পানি (পিএইচপি শিপব্রেকিং) আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।
মিকেলিস জানান, মায়েরস্ক-এর মতো বড় বড় কোম্পানিরগুলোর সরাসরি ইয়ার্ডের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে। তিনি বলেন, এই শিল্প উন্নতি চায় কিন্তু এ জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন।
জোডিয়াক-এর বিষয়ে মার্টিন ডে দাবি করেন, চট্টগ্রাম জাহাজ গলানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা জানে। অনিরাপদ পরিবেশে তা ভাঙা হবে জেনেও তারা ইউরোস লন্ডনকে বিক্রি করেছে সেখানে। তিনি বলেন, নগদ ক্রেতা বা ঠিকাদারের মাধ্যমে বাংলাদেশে জাহাজ বিক্রি না করা তাদের দায়িত্ব।
এক বিবৃতিতে জোডিয়াক জানায়, তৃতীয় পক্ষের কাছে জাহাজ বিক্রির চার মাস পর দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এর ফলে ‘ইদ্রিস যে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে তার দায় আমরা অস্বীকার করছি এবং এই দাবিতে আপত্তি জানাচ্ছি’।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘যে ইয়ার্ডে ইদ্রিস কর্মরত ছিলেন তা জোডিয়াকের ঠিকাদারের নয় এবং জোডিয়াক জাহাজ গলানোর জন্য ইয়ার্ডটি নির্বাচন করেনি। জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডে কাজের পদ্ধতির বিষয়ে জোডিয়াকের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। অবহেলার যে কোনও আইনি এখতিয়াবহির্ভূত এই দাবি। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন প্রযোজ্য।’
যেকোনও দুর্ঘটনার প্রভাব শ্রমিকের পরিবারের দুর্যোগ বয়ে আনে। ইদ্রিসের পরিচিত এক ব্যক্তি বলেন, তার (ইদ্রিস) কোনও সঞ্চয় নেই। তিনি ক্ষুব্ধ। বন্ধু ও আত্মীয়দের দয়ার উপর সে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তার ছেলেমেয়েরা আতঙ্কিত কারণ সে ব্যথা ও যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার করেন প্রায় সময়েই।
ইদ্রিসের কথায়, ‘নিজেকে মৃত বলে মনে হয়। আমার কোনও আশা নেই। আমি কখনও আর কাজ করতে পারব না। আমার শরীরে স্টিলের টুকরা রয়েছে। শুধু লাঠিতে ভর দিয়ে আমি চলতে পারি। খুব যন্ত্রণার মধ্যে আছি। আমি একটি দোকান খুলতে চাই। কিন্তু এজন্য পাঁচ লাখ টাকা প্রয়োজন।’
জাহাজ ভাঙার কাজে পঙ্গু হওয়া ইদ্রিস আরও বলেন, ‘অনেক মানুষকে মরতে ও আহত হতে দেখেছি আমি। এটা খুব বিপজ্জনক কাজ। মানুষকে সেখানে কাজ না করার জন্য বলি আমি।’
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন