তৃণমূল নেতারা সবসময়ই কেন্দ্রীয় নেতাদের এক ধরনের চাপে থাকেন। তবে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিদ্রোহী প্রার্থী ইস্যুতে এখন উল্টো চাপ ও ভয়ে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। আতঙ্কে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলটির সংসদ সদস্যরাও। কারণ দলীয় প্রতীকে পাঁচ ধাপে শেষ হওয়া এ নির্বাচনে দল মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করে যারা প্রার্থী হয়েছেন তারাও আওয়ামী লীগেরই। আর পদধারী নেতারা বহু স্থানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে দল মনোনীত প্রার্থীদের পরাজিতও করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে শুরুতে বিদ্রোহীদের নিয়ে কঠোর কোনো অবস্থানে না গেলেও নির্বাচন শেষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্র থেকে ‘সিরিয়াস’ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। এরই অংশ হিসেবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিদ্রোহী প্রার্থীদের শোকজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। আগামী রবিবার থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, শোকজের এ সিদ্ধান্তে দলের ভেতরে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন। কারণ বিদ্রোহীদের আশকারা ও মদদ দিয়েছেন কমপক্ষে একডজন কেন্দ্রীয় নেতা। দলের শতাধিক সংসদ সদস্য সরাসরি বিদ্রোহীদের পক্ষে মাঠে কাজ করেন। কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীও বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিলেন। এখন কেন্দ্র থেকে সেসব বিদ্রোহীকে শোকজ করা হলে তারাও ফেঁসে যেতে পারেন, দাঁড়াতে হতে পারে কাঠগড়ায়Ñ এই শঙ্কা পেয়ে বসেছে তাদের ভেতরে। কেন্দ্রীয় ওই নেতারা বলেন, সভাপতিম-লীর সদস্য, সম্পাদকম-লীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় সদস্যসহ অন্তত একডজন নেতা উপজেলায় বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, বিদ্রোহীদের পক্ষে ডিসি, এসপিসহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগও করেছেন কেন্দ্রীয় ওই নেতারা। এর সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা মদদ দিয়েছেন বিদ্রোহীদের। মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হওয়ায় এ কাজ করেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে বিজয়ী চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহউদ্দিন টিপু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা যখন উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোট করি তখন কেন্দ্র থেকে বা জেলা থেকে দায়িত্বশীলরা কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। তখন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এতদূর গড়াত না। বরং কেন্দ্র থেকে তখন উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যখন অপরাধ করতে যাচ্ছি, তখন বাধা দিল না বরং উৎসাহ দিল। এখন শাস্তির সিদ্ধান্ত কেন?’ টিপু এ সময় প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘শুধু উপজেলা নির্বাচনে শাস্তি কেন? যারা জাতীয় নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাদের কী হবে?’
টিপুর মতো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আরও অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী এবং তাদের মদদদাতারা। আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর দুই সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক এলাকায় মারামারির ঘটনাও ঘটবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের চেয়ে যেসব কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্য, এমনকি মন্ত্রী রয়েছেনÑ আশকারা ও মদদদানকারী সেসব নেতারা এখন ভয়ে আছেন। তাদের আশঙ্কা, শোকজের জবাবে তাদের নাম প্রকাশ করে দিলে পরিণতি কী হবে? এমন পরিস্থিতিতে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যরা যোগাযোগ করছেন যেন তারা শোকজের জবাবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না আনেন। কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা তাদের শিষ্যদের ভয়ও দেখাচ্ছেন, যাতে শোকজের জবাবে বিদ্রোহে তাদের উসকানি বা মদদ দেওয়ার বিষয় উঠে না আসে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে জানান, দলটির ভেতরে প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা চান বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কড়া কোনো সিদ্ধান্তে না যেতে। কারণ এতে আসন্ন সম্মেলন নিয়ে দলের তৃণমূলে অনৈক্য দেখা দেবে; মারামারির ঘটনা আরও বাড়বে। এসব যুক্তি দেখিয়ে এবারের মতো বিদ্রোহী ইস্যুটি চেপে যাওয়ার পক্ষে মত তাদের।
সম্পাদকম-লীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, শোকজ করে ক্ষ্যান্ত দেওয়া হবে বিদ্রোহী ইস্যুটি। কারণ এখানে দলের অনেক বড় বড় নেতা বিদ্রোহীদের আশকারা দিয়েছেন, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে মন্ত্রীরা পর্যন্ত দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ফলে ব্যাপারটি নিয়ে ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ করলে ক্ষতি হবে দলেরই বেশি। কারণ বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার আগে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যেসব নেতা মদদ দিয়েছেন তাদেরকেই।
এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচন করেছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন। তিনি বলেন, অনেক উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ ছিল বিদ্রোহীদের জেতানোর ব্যাপারে। তবুও দলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শোকজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শোকজের পরে বিদ্রোহীদের জবাব পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য ফারুক খান বলেন, ইস্যুটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।