জাতিসংঘ সদর দফতরে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ফ্রেন্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড বা ‘বিশ্ব বন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বক্তারা। বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) সংস্থাটির সদর দফতরে প্রথমবারের মতো জাতীয় শোক দিবসের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় জাতিসংঘের কনফারেন্স রুম-৪ (চার) এ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন জাতিসংঘের সদস্য দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা, নিউ ইয়র্কস্থ যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার মানবাধিকার কর্মী, লেখক, চলচিত্র শিল্পী, টিভি উপস্থাপক, ফটোগ্রাফার এবং প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনেরা।
এর আগে সকাল ৯টায় স্থায়ী মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে জাতির পিতার ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি শুরু করা হয়।
এ সময় ১৫ আগস্টের শহীদদের উদ্দেশে মিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ এবং ১৫ আগস্টের শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়ার মাধ্যমে সকালের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি শেষ হয়।
বিকেলে জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত শোক দিবসের মূল অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
এ সময় দেশি-বিদেশি অতিথিরা জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করেন।
এরপর জাতির পিতার জীবন ও কর্ম এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও বহুপাক্ষিকতাবাদ’ বিষয়ে কী-নোট স্পিচ প্রদান করেন জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী।
বক্তব্য দেন ভারত, সার্বিয়া ও কিউবার স্থায়ী প্রতিনিধি এবং ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক। প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের পক্ষে বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। সাংস্কৃতিক পর্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা ও গান পরিবেশন করা হয়।
সবশেষে জাতির পিতা, বঙ্গমাতা এবং ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রিতে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির হাতে নৃশংসভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ তার স্বাগত ভাষণে জাতির পিতা জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকারের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি, গণতন্ত্র, শান্তি ও সহবস্থানের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা তুলে ধরেন।
জাতিসংঘ সদর দফতরে প্রথমবারের মতো জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকীর এ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা আগামী বছর বিশ্বব্যাপী জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। সে উপলক্ষে জাতিসংঘ সদর দফতরে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি ২০২১ সালে উদযাপন করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী।’
এ সব অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান স্থায়ী প্রতিনিধি।
জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্ব বন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেন।
তিনি জাতির পিতার সঙ্গে তার কর্মজীবনের নানা ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তুলে ধরা, বহুপাক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নেয়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে সব অবদান রাখেন তা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পররাষ্ট্রনীতি ‘‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’’ ধারণ করেই বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতাবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বসভায় ভূমিকা রেখে চলেছে।’
ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেন, ‘১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারতবাসী তাদের অকৃত্রিম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা জানতে পারে তখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়।’
বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শই আজ জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘এটি সম্ভব হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
সার্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিলান মিলানোভিচ্ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিকা দাচ্চির বাণী পড়ে শোনান। এ বাণীতে সার্বিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ ব্রোজো টিটোর যে বন্ধুত্ব ও গভীর সম্পর্ক তা তুলে ধরেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি ‘বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, আর আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও এটা যে আমি তাদের অনেক বেশি ভালোবাসি’ উল্লেখ করেন।
কিউবার রাষ্ট্রদূত আনা সিলভিয়া রদ্রিগেজ আবাসকাল তার বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার দেয়া অকুণ্ঠ কূটনৈতিক সমর্থনের কথা তুলে ধরেন। নির্যাতিতের পক্ষে ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব, প্রচেষ্টা ও সাহসের কথা বলতে গিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালে কিউবার মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সেই বিখ্যাত উদ্বৃতি ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাই হিমালয় দেখার সাধ আর আমার নেই’ উল্লেখ করেন।
ফিলিস্তিনের স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ এইচ মনসুর ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আজ ৪৪ বছর পর এ জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে যা এ বিশ্বনেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অনন্য উদ্যোগ।’
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান মুজিব শতবর্ষ উদযাপনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বক্তারা বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির প্রতিভূ ও বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তারা বলেন, বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার সংগ্রাম ও ত্যাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।
জাতিসংঘে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল মিজ সাদিয়া ফয়জুনেচ্ছা এবং স্থায়ী মিশন, কনস্যুলেট ও জাতিসংঘ সদর দফতরে কর্মরত বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মুকিত চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রবাসী বাংলাদেশিরা।