এনালগ ক্যামেরার যুগে যখন ফিল্মে ছবি তুলতেন, সেই সময়ের পৃন্ট করা ছবি দেখবেন কোনোটায় সবুজ ভাব বেশি, কোনোটা লালচে। আমি এর কারণ বুঝতাম না, বাড়িতে আব্বার কয়েটা ছবি আছে, এক রঙা কিন্তু কালো না, যেগুলোকে বলে “সেপিয়া”। ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে এসে বুঝতে পেরেছি ছবিগুলোর ভিন্নতার কারণ।
সেই যুগে দোকানে গিয়ে র্যান্ডম একটা ফিল্ম কিনে নিতাম। ব্র্যান্ড ছিল আগফা, ফুজিফিল্ম, কোডাক, আর এদের সাব-ব্র্যান্ড ছিল অনেক। কিন্তু সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কেওই হয়তো মাথা ঘামাত না। যেকোনোটা কিনে আনত, হয়ত যেটার দাম কম। আমি আগফা, ফুজি ব্যবহার করে থিতু হয়েছিলাম কোডাক গোল্ড ২০০ তে। এর কারণ হল এটার দাম ছিল দশ টাকা বেশি, দাম যেহেতু বেশি মানও নিশ্চই ভাল হবে। একারণে আমার পরের দিকের ছবিগুলোতে লালচে-গোলাপি আভা আছে।
আমি যখন ফিল্ম সিমুলেশনের সাথে পরিচিত হলাম তখন কোডাক গোল্ড ২০০ নামে একটা রেসিপি দেখলাম। টার্ম দুটো অপরিচিত মনে হচ্ছে?
এক কথায় ফিল্ম সিমুলেশন হল ডিজিটাল ক্যামেরায় ফিল্মের মত কালার টোন আনা। ফুজিফিল্ম ক্যামেরার একটি বিশেষ ফিচার, যা ডিজিটাল ছবির ওপর নির্দিষ্ট কালার টোন, কনট্রাস্ট এবং ফিল্ম-স্টাইলের লুক যুক্ত করে, যেন ছবিগুলো ঐতিহ্যবাহী ফুজিফিল্ম এনালগ ফিল্মের মতো দেখায়।
আর ফিল্ম রেসিপি হল ফিল্ম সিমুলেশনকে কাস্টমাইজ করে আরও ব্যতিক্রম কালার টোন আনা বা স্পেসিফিক কোনো সাব-ব্র্যান্ড ফিল্মের মত কালার আনা। যেমন রেসিপির তালিকায় কোডাক গোল্ড ২০০ নামটা দেখে ও সেই রেসিপিতে ছবি তুলে আমি বুঝতে পারলাম ফিল্ম যুগে এতো ভিন্ন ভিন্ন নামের ফিল্ম কেন ছিল। এগুলো আসলে এক রকম ছিল না, ভিন্ন ভিন্ন ফিল্ম ফটোগ্রাফারকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ দিত।
কোডাক গোল্ড ২০০ রেসিপিতে ছবি তুলেছি, যদিও ছবি সেই ফিল্ম ছবির চেয়ে অনেক বেশি ভাইব্র্যান্ট, অনেক বেশি লালচে, উজ্জল।
মজা পেয়ে গেলাম। মনে হল পুরোনো যুগে সব ফিল্ম আমার হাতে। রেসিপি পাল্টে যেকোনো ফিল্ম ফ্রিতে কিনে আনো। সেই সাথে কেমন কেমন কী কী নামের ফিল্ম ছিল সেই আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
তখন একটা ফিল্মের দাম ছিল ১০০ টাকা থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে, এখন দেড় হাজার টাকার উপরে। ভাবা যায়! কিছু বড়লোক ফটোগ্রাফার এই যুগেও ফিল্মে ছবি তুলেন! কী এস্থেটিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে!
হারিয়ে যাওয়া দিনের প্রতি মানুষের এতো আগ্রহ। আর ফুজিও ডিজিটাল যুগে ঢুকেও তার ফিল্মের সোনালী দিনকে ভুলতে পারছে না। ডিজিটালে ঢুকিয়ে দিয়েছে ফিল্ম। আর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মানুষ এখন বেশি দাম দিয়ে হলেও ফুজিফিল্ম ক্যামেরা কিনছে। শুধু এই হাইপের কারণে তাদের একটা সিরিজ X100 এর লেটেস্ট মডেলের দাম বেড়ে দুই লাখ টাকা ছাড়িয়েছে!
ফিল্ম সিমুলেশন কিভাবে কাজ করে?
ফুজিফিল্ম বহু বছর ধরে তাদের এনালগ ফিল্ম তৈরি করত, যেমন Velvia, Provia, Acros, Astia ইত্যাদি। এসব ফিল্মের আলাদা আলাদা রঙ, টোন, এবং ডাইনামিক রেঞ্জ ছিল। ফুজিফিল্ম তাদের ডিজিটাল ক্যামেরায় এই ফিল্মের কালার প্রোফাইল ও চরিত্র অনুকরণ করে “ফিল্ম সিমুলেশন” হিসেবে যুক্ত করেছে।
জনপ্রিয় ফুজিফিল্ম ফিল্ম সিমুলেশনসমূহ
- Provia/Standard – ন্যাচারাল লুক, সব ধরনের ফটোগ্রাফির জন্য ভালো
- Velvia – বেশি স্যাচুরেটেড রঙ, ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফির জন্য পারফেক্ট
- Astia – সফট টোন, সুন্দর স্কিন টোনের জন্য আদর্শ
- Classic Chrome – ফেডেড ও কনট্রাস্টি লুক, ম্যাগাজিন-স্টাইল ফটোর জন্য
- Acros – ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফিল্ম সিমুলেশন, ডিপ কনট্রাস্ট
- Classic Negative – রেট্রো এবং ফিল্মি লুক
- Eterna – সিনেমাটিক, লো-কনট্রাস্ট কালার প্রোফাইল
- Eterna Bleach Bypass – বেশি কনট্রাস্ট ও ডেস্যাচুরেটেড লুক
- Nostalgic Neg – ওয়ার্ম, সফট টোন (X-T5, X-H2, X100VI-তে নতুন)
কেন ফিল্ম সিমুলেশন ব্যবহার করবেন?
- সরাসরি ক্যামেরা থেকে সুন্দর ছবি পাওয়া যায়, এডিট করতে হয় কম
- প্রত্যেকটি সিমুলেশনের আলাদা মুড ও ফিলিং আছে
- JPEG বা HEIF আউটপুটেও প্রফেশনাল-লুক পাওয়া যায়
- RAW ফাইলেও ফিল্ম সিমুলেশন সংরক্ষণ করা যায় ও পরে পরিবর্তন করা যায়, আবার সিমুলেশন ছাড়া মূল ছবিও পাওয়া যায়
ফুজিফিল্ম ফিল্ম সিমুলেশনের ইতিহাস
১৯৩৪: ফুজিফিল্মের যাত্রা শুরু
ফুজিফিল্ম (Fuji Photo Film Co., Ltd.) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে এবং দ্রুত ফটোগ্রাফিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করে।
১৯৫০-১৯৯০: আইকনিক ফুজি ফিল্মের জনপ্রিয়তা
ফুজি ফিল্মের Velvia, Provia, Astia, Acros-এর মতো কালার ও ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট ফিল্ম ফটোগ্রাফারদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। বিশেষ করে,
- Velvia (১৯৯১) – স্যাচুরেটেড রঙের কারণে ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফারদের পছন্দ
- Provia – ব্যালান্সড ও ন্যাচারাল টোন
- Astia – সফট স্কিন টোনের জন্য পারফেক্ট
- Acros – ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট ফটোগ্রাফির জন্য লিজেন্ডারি
২০০০-২০১০: ডিজিটাল যুগ ও ফিল্মের পতন
ডিজিটাল ক্যামেরার জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে এনালগ ফিল্মের বাজার কমতে থাকে। কিন্তু ফুজিফিল্ম তাদের ফিল্মের রঙ এবং টোন ডিজিটাল ফটোগ্রাফিতে আনার চেষ্টা করে।
২০০৩: প্রথম ফিল্ম সিমুলেশন ফিচার
ফুজিফিল্ম FinePix S3 Pro ক্যামেরায় প্রথমবারের মতো ফিল্ম সিমুলেশন প্রিসেট চালু করে। এতে মূলত Provia, Velvia, Astia ছিল।
২০১১: X-Series ক্যামেরায় উন্নত ফিল্ম সিমুলেশন
ফুজিফিল্ম X100 (২০১১) ক্যামেরা দিয়ে নতুন এক ডিজিটাল অভিজ্ঞতা তৈরি করে। এটিতে উন্নত ফিল্ম সিমুলেশন ছিল, যা সরাসরি JPEG-এ ফিল্ম-স্টাইলের ছবি দিত। এরপর X-Series ক্যামেরাগুলোতে নিয়মিত নতুন ফিল্ম সিমুলেশন যুক্ত হতে থাকে।
২০১৩: Classic Chrome – ম্যাগাজিন স্টাইল লুক
Classic Chrome ফিল্ম সিমুলেশন চালু করা হয়, যা ম্যাগাজিন ও ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির জন্য দারুণ জনপ্রিয় হয়।
২০১৭-বর্তমান: সিনেমাটিক ও নস্টালজিক সিমুলেশন
- Eterna (2017) – সিনেমাটিক লুক
- Classic Negative (2019) – ১৯৯০-এর দশকের ফিল্ম ক্যামেরার মতো টোন
- Nostalgic Neg (2022) – ১৯৭০-এর দশকের কালার ফটোগ্রাফির অনুপ্রেরণা
ভবিষ্যৎ: AI-ভিত্তিক ফিল্ম সিমুলেশন?
ফুজিফিল্ম ভবিষ্যতে AI-ভিত্তিক কাস্টমাইজেবল ফিল্ম সিমুলেশন তৈরি করতে পারে, যেখানে ইউজার তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী ফিল্ম লুক ডিজাইন করতে পারবে।
সংক্ষেপে, ফুজিফিল্ম তাদের এনালগ ফিল্মের জনপ্রিয়তাকে ডিজিটাল ক্যামেরায় সংযুক্ত করার জন্য ফিল্ম সিমুলেশন তৈরি করে। এটি ফটোগ্রাফারদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা এনে দেয়, যেখানে তারা পোস্ট-প্রসেসিং ছাড়াই সরাসরি ক্যামেরায় ফিল্ম-স্টাইলের ছবি তুলতে পারে।
ফুজিফিল্ম ছাড়া অন্যান্য ক্যামেরায় ফিল্ম সিমুলেশন বা অনুরূপ ফিচার
Nikon (পিকচার কন্ট্রোলস – Picture Controls)
- Nikon-এর “Picture Control” অপশন ফুজিফিল্মের ফিল্ম সিমুলেশনের মতো কাজ করে, যা JPEG ও ভিডিওতে নির্দিষ্ট রঙ ও কনট্রাস্ট দেয়।
- Standard, Neutral, Vivid, Monochrome, Flat
- Creative Picture Controls – Dream, Morning, Pop, Bleach, Melancholic ইত্যাদি নতুন স্টাইল
Canon (পিকচার স্টাইলস – Picture Styles)
- Canon ক্যামেরায় “Picture Style” বলে একটি ফিচার আছে, যা নির্দিষ্ট কালার প্রোফাইল দেয়।
Standard, Portrait, Landscape, Neutral, Faithful, Monochrome
Custom Picture Styles ডাউনলোড ও ইমপোর্ট করা যায়
ইউজাররা “Kodak, Fuji, Agfa” লুকের জন্য কাস্টম স্টাইল বানাতে পারে
Sony (ক্রিয়েটিভ লুক – Creative Look & পিকচার প্রোফাইল)
- Sony-এর নতুন ক্যামেরাগুলোতে “Creative Look” ফিচার এসেছে, যা ফিল্ম-স্টাইলের রঙ ও কনট্রাস্ট তৈরি করে।
Creative Look (Standard, Vivid, Neutral, Instant, Light, Deep, Night, Autumn, Black & White)
S-Log & HLG Profiles (সিনেমাটিক কালার গ্রেডিংয়ের জন্য)
Custom LUTs যোগ করা যায় (A7S III, A7 IV, FX3 ইত্যাদিতে)
Panasonic (ফিল্ম লুকস ও V-Log)
- Panasonic ক্যামেরাগুলোতে কিছু ফিল্ম লুক প্রিসেট ও V-Log অপশন থাকে, যা সিনেমাটিক ও ফিল্মিক লুক দিতে পারে।
Cinelike-D, Cinelike-V, L.Monochrome, Vivid, Natural
V-LogL – সিনেমাটিক কালার গ্রেডিংয়ের জন্য ফ্ল্যাট প্রোফাইল
Olympus/OM System (কালার প্রোফাইল ও Art Filters)
- Olympus (OM System) ক্যামেরাগুলোতে কিছু ক্রিয়েটিভ কালার প্রোফাইল এবং “Art Filters” দেওয়া থাকে।
- Vivid, Natural, Muted, Portrait, Monochrome
- Art Filters – Vintage, Grainy Film, Bleach Bypass ইত্যাদি
Leica (Film Modes & Monochrome Profiles)
- Leica ক্যামেরাগুলোতে কিছু নির্দিষ্ট ফিল্ম-স্টাইলের কালার প্রোফাইল থাকে।
Standard, Vivid, Natural, Monochrome
Leica M10 Monochrom – খাঁটি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফটোগ্রাফির জন্য
কোন ব্র্যান্ড ফুজিফিল্মের সবচেয়ে কাছাকাছি?
ফুজিফিল্মের মতো পুরোপুরি ফিল্ম-স্টাইলের সিমুলেশন অন্য ক্যামেরায় পাওয়া যায় না, তবে Nikon, Canon, এবং Sony-তে কিছু কাস্টমাইজড প্রোফাইল ব্যবহার করে কাছাকাছি ফলাফল পাওয়া যায়।
Leica ও Olympus কিছু ক্ষেত্রে ফুজিফিল্মের মতো ফিল্মি লুক দিতে পারে, বিশেষ করে কালার টোন ও Monochrome ফটোগ্রাফিতে।
Ricoh GR ক্যামেরার ফিল্ম লুক বা Image Control
Ricoh GR III ও GR IIIx ক্যামেরাগুলোতে বিল্ট-ইন কিছু Film-Like Image Control Modes রয়েছে, যা JPEG ছবির জন্য নির্দিষ্ট কালার টোন, কনট্রাস্ট ও টেক্সচার অ্যাডজাস্ট করতে দেয়।
- Standard – ন্যাচারাল ও ব্যালান্সড লুক
- Vivid – উজ্জ্বল ও বেশি স্যাচুরেটেড কালার
- Positive Film – ফুজিফিল্মের Classic Chrome বা Kodak Ektachrome-এর মতো লুক
- Black & White – স্ট্যান্ডার্ড মনোক্রোম
- Hard Monotone – উচ্চ কনট্রাস্ট ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট
- Hi-Contrast B&W – খুব বেশি কনট্রাস্ট দেওয়া ড্রামাটিক লুক
- Soft Monotone – সফট টোনযুক্ত ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট
- Bleach Bypass – ফ্ল্যাট, ডিস্যাচুরেটেড সিনেমাটিক লুক
- Retro – পুরোনো ফিল্মের মতো ফেইডেড কালার
- HDR Tone – আর্টিস্টিক HDR ইফেক্ট
Ricoh-এর Image Control vs. Fujifilm Film Simulation
- Ricoh GR সিরিজে ফিল্ম-স্টাইলের কালার প্রোফাইল থাকলেও, ফুজিফিল্মের মতো Grain Effect বা Color Chrome-এর মতো গভীর টিউনিং অপশন নেই।
- “Positive Film” মোডটি ফুজিফিল্মের Classic Chrome-এর মতো কাজ করে, যা ম্যাগাজিন-স্টাইল বা ফিল্মি টোন দেয়।
- Ricoh-এর “Retro” ও “Bleach Bypass” মোড সিনেমাটিক ও নস্টালজিক ফিল্ম লুক তৈরি করতে পারে।
- ব্যবহারকারীরা Custom Image Control সেটিংস টুইক করতে পারে, তবে ফুজিফিল্মের মতো আলাদা আলাদা “Film Simulation” নেই।
তাহলে Ricoh কি ফুজিফিল্মের বিকল্প হতে পারে?
- Ricoh GR সিরিজ মূলত স্ট্রিট ফটোগ্রাফির জন্য পারফেক্ট, এবং তাদের Positive Film ও Retro মোড ফুজিফিল্মের ফিল্ম সিমুলেশনের কাছাকাছি কিছুটা লুক দিতে পারে।
- তবে ফুজিফিল্মের মতো কাস্টম রেসিপি বানানোর সুযোগ নেই – কারণ Ricoh-তে WB Shift, DR, Grain, বা Color Chrome-এর মতো গভীর কাস্টমাইজেশন অপশন নেই।
- যদি ফুজিফিল্মের মতো এক্সটেনসিভ ফিল্ম সিমুলেশন খোঁজেন, তাহলে Ricoh পুরোপুরি বিকল্প হবে না। তবে স্ট্রিট ফটোগ্রাফির জন্য দারুণ।
আর সব কিছুর পরে আপনার নিজের বানানো একটা ফিল্ম থাকে, তবে সেটাকে বলে ফিল্ম রেসিপি! সেটা পরের আর্টিকেলে।
