১.
জুন ৮, ১৯৩০।
বিশ্বকাপের বাকি ৩৫ দিন।
রোমানিয়ায় রাজার মুকুট পরলেন দ্বিতীয় কার্লো। নতুন রাজার আগমনে রোমানিয়াজুড়ে উৎসব তো ছিলই, কোথাও কোথাও ছিল সংশয়ের মেঘও । সেটি অবশ্য রাজাকে নিয়ে নয়, দেশের ফুটবল পাড়াতেই সীমাবদ্ধ। ফিফার ৪২ সদস্যের একটি রোমানিয়া। পরের মাসে বিশ্বকাপ, ফিফার কাছ থেকে আমন্ত্রণ এসেছে অনেক আগেই। আমন্ত্রণপত্রে অবশ্য তেমন গৌরবের কিছু নেই, ফিফার সব সদস্যের কাছেই গেছে এই চিঠি।
রোমানিয়া আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা শুরু করেছে মাত্র ৮ বছর আগে, কার্লো যেদিন ক্ষমতায় বসলেন, ঠিক সেইদিনেই। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্পেনের মতো দল বিশ্বকাপকে না করে দিয়েছে আরও আগে। কিন্তু রোমানিয়ার রাজা সেই অভাবনীয় কাজটাই করলেন- দলকে বিশ্বকাপে পাঠাবেন তিনি। রাজা হিসেবে এটাই যেন তার প্রথম কাজ, দায়িত্বও বটে!
অথচ রোমানিয়া দলের মূল খেলোয়াড়রা নানান কারণে এতোদিন নিষিদ্ধ ছিল ফুটবল থেকেই। নতুন রাজার হুকুমে এক নিমিষেই সবার নিষেধাজ্ঞাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কোচ নয়, বিশ্বকাপে রোমানিয়ার দল বাছাই করলেন রাজা কার্লো নিজেই।
সেই দলের অনেকের আবার বিশ্বকাপে যাওয়া নিয়েও দ্বিমত ছিল। দলের অনেকেই পেশাদার ফুটবলার নন, কাজ করেন ইংলিশ তেল কোম্পানিতে। যে করে খনিতে শ্রম, তারে যেন ডরে যম- এই মন্ত্র সেখানে কাজে দিল না। কোম্পানির কাছে তিন মাসের ছুটি তো মিলছিলই না, আবার উরুগুয়ে গেলে চাকরিতে থেকে ছাঁটাই করে দেওয়ার নোটিশও জারি হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে খাবেন কি তারা? এখানেও রাজামশায় হাজির। এক ডাকে শায়েস্তা সবাই, রোমানিয়া বিশ্বকাপেই যাচ্ছে।
২.
১৯০৪ সালে ‘ফিফা’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফুটবলের বৈশ্বিক একটা টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথা চলছিল। তখনও পর্যন্ত অলিম্পিকে সোনা জেতাই ছিল ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের সূচক। ১৯২০ থেকে অলিম্পিকে ফুটবলের পুরো আয়োজনের কর্তৃত্ব পায় ফিফা। টানা তিন আসর ফিফা আর অলিম্পিক কমিটি কাজও করছিল কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে। এরপরই বিপত্তিটা বাঁধে দুই পক্ষের। ফিফাও মন দেয় বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের দিকে। খসড়া অনুযায়ী ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ নির্ধারণ করা হয় আয়োজক দেশের নাম উহ্য রেখেই। নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ইতালি, সুইডেনের সঙ্গে বিশ্বকাপ আয়োজকদের আগ্রহীদের তালিকায় উরুগুয়ের নামও ছিল। উরুগুয়ে বাদে বাকি ইউরোপিয়ান দেশগুলোই এগিয়ে ছিল প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের দৌড়ে। কিন্তু ১৯২৯ সালে অনেকটা আচমকা সেই উরুগুয়েই বাকিদের টপকে পেয়ে যায় বিশ্বকাপ আয়োজনের ভার! নাকি সম্মান?
ফিফার এমন সিদ্ধান্তে শুরু থেকেই বাধ সেধেছিল ইউরোপিয়ান দেশগুলো। বিশ্বকাপের আগেই আগ্রহী বাকি ৪ দেশ একরকম বিদ্রোহ করেই বর্জন করে বিশ্বকাপ, সঙ্গে যোগ দেয় হাঙ্গেরিও। অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডও আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ফুটবল দল পাঠাবে না উরুগুয়েতে। ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের দেশ ফ্রান্সও শুরুতে ‘না’ করে দিয়েছিল। পরে জুলে রিমের অনুরোধে প্রথমে রাজি হয় ফ্রান্স ,পরে বেলজিয়াম।
সবকিছুর আগেই অবশ্য ভ্রমণকারী দলের সবরকম খরচ নিজেরাই বহন করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল উরুগুয়ের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। সেটাও মন গলাতে পারেনি ইতালি, জার্মানির। উরুগুয়ের বিশ্বকাপ নিয়ে অনুমিতভাবেই আমেরিকার দলগুলোর তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। আর নিজেদের ফুটবলের ধারক-বাহক দাবি করে আসা ব্রিটেন তো ততোদিনে উলটো পথে যাত্রা শুরু করেছে, ফিফা থেকে বেরই হয়ে গেছে তারা! উরুগুয়ে অবশ্য তবুও চেষ্টাটা চালিয়েছিল, সদস্য না হয়েও ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ খেলার আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল তারা। সেই চিঠি লন্ডন পৌঁছাতে পাড়ি দিয়েছে বহুপথ, কিন্তু ইংলিশ এফএর কাছে নাকচ হতে সময় নেয়নি একেবারেই!
তাই দক্ষিণ আমেরিকার ৭ দেশ, সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো; ইউরোপের চার আর আফ্রিকার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মিশর নিশ্চিত করল বিশ্বকাপ। ১৪ দল নিয়েই উরুগুয়েতে নামবে প্রথম বিশ্বকাপের পর্দা, সঙ্গে খেলার দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল।
৩.
উরুগুয়ের পথে রোমানিয়ার যাত্রা শুরু ইতালির জেনোয়া থেকে। দুইদিন ট্রেনে ভ্রমণ করে নিজেদের দেশ থেকে ইতালি পৌঁছেছে রোমানিয়া ফুটবল দল। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিলাসবহুল জাহাজ কন্তে ভার্দে। জেনোয়া থেকে রোমানিয়ার ২১ জন যাত্রী নিয়ে যাত্রা আরম্ভ করে জাহাজ ভিড়ল মার্শেইতে। ডি আজুর বন্দর থেকে উঠল পুরো ফ্রান্স দল আর ম্যাচ পরিচালনার জন্য তিনজন রেফারি। সঙ্গে উঠলেন আরও একজন। ধূসর স্যুট, কালো টাই পরা সাদা চুলের এক ভদ্রলোক, হাতে তার একটা চামড়ার স্যুটকেস।
ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে, আর হাতের ব্যাগটায় রাখা সেই শিরোপা।
বার্সেলোনার বন্দরে জাহাজের জন্য অপেক্ষা করছিল আরেকদল, বেলজিয়াম। সেখান থেকে তাদের উঠিয়ে নিয়ে তিন দল মিলেই রওয়ানা হল উরুগুয়ের দিকে।
ইউরোপের আরেক দল যুগোস্লাভিয়া সিদ্ধান্তটা নিতে দেরি করে ফেলেছিল বেশ কিছুদিন। ততোদিনে কন্তে ভার্দের সব সিট বুক হয়ে গেছে। তাই আলাদা করে আরেকটা জাহাজ ভাড়া করতে হল তাদের। মার্শেইতে মিশরকে নিয়ে একসঙ্গে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল তাদের। কিন্তু ঝড়ে আটকা পড়ে আফ্রিকা থেকে রওয়ানা দিতেই দেরি হয়ে গেল তাদের। উপায় না দেখে মিশরকে ছাড়াই যাত্রা শুরু করল যুগোস্লাভিয়া। সেই বিশ্বকাপে আর খেলাই হলো না মিশরের। বিশ্বকাপে দলের সংখ্যাটাও হয়ে গেল বেঢপ, ১৩।
৪.
“ট্যাকটিকস নিয়ে কোনো কথাই হচ্ছিল না, না ফুটবল কোচিং নিয়ে। ডেকের ওপর দৌড়ানো আর নিচে গিয়ে স্ট্রেচিং করা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামাও ছিল অনুশীলনের ভেতর। ওখানে একটা সুইমিং পুলও ছিল। শীত পড়ার আগ পর্যন্ত আমরা ওখানে সাঁতার কাটতাম। বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা ছিল হলিডে ক্যাম্পের মতো। আমাদের জন্য একটা অভিজ্ঞতা। উরুগুয়ে যাওয়ার সময়ও এই যাত্রার মাহাত্ম্য আমরা বুঝতে পারিনি। অনেকদিন পর যখন ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছি তখন বুঝেছি। আসলে আমরা কিছু তরুণ যুবক জাহাজে আনন্দ করছিলাম। কন্তে ভার্দেতে করে পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছিল ১৫ দিন। ওই ১৫ দিন ছিল সুখের ১৫ টা দিন।“ – ফ্রান্স ফুটবলার লুসিয়েন লরেন্টের ভাষায় জাহাজে কাটানো দিনগুলো।
জলযাত্রাটা যে একেবারে মন্দ ছিল না সেটা তো স্পষ্টই। তিন দল এক জাহাজে অথচ সেখানে ফুটবল বাদে হয়েছে বাকিসব কিছুই। খেলার জায়গা থাকলে হয়ত প্রস্তুতি ম্যাচগুলোও সেরে নেওয়া হত সেখানেই! দুই সপ্তাহের বেশি জাহাজ ভ্রমণের পর খেলোয়াড়দের শারীরিক অবস্থা কেমন দাঁড়ায় সেটা নিয়েও সংশয় ছিল। তাই কোচরা খেলার চেয়ে বরং শারীরিক অনুশীলনের দিকেই মন দিয়েছিলেন বেশি।
উরুগুয়ে যাওয়ার পথে জাহাজ আরও একবার থামলো মাঝপথে। এবার রিও ডি জেনিরোতে। সেখান থেকে ব্রাজিল দলকে তুলে আরও একদিন লাগল উরুগুয়ে পৌঁছাতে।
স্বাগতিক উরুগুয়ের অবশ্য এসব ভ্রমণের চিন্তা ছিল না। আসলে প্রতিপক্ষকে নিয়েও খুব বেশি ভাবতে হয়নি তাদের। আগের দুইবারের অলিম্পিকে সোনাজয়ী দল তারা। ঘরের মাঠে তো বটেই, পরের মাঠে বিশ্বকাপ হলেও উরুগুয়েই থাকত পরিষ্কার ফেভারিট। তবে ইউরোপের দলগুলো না থাকায় উরুগুয়ের প্রতিবেশি আর্জেন্টিনাও ছিল সম্ভাব্য বিশ্বকাপ জয়ী তালিকায় ঠিক পরের স্থানেই।
৫.
বিশ্বকাপটা সেবার আসলে যত না উরুগুয়েতে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি মন্টেভিডিওতে। উরুগুয়ের রাজধানী শহরেই আয়োজন, তিন স্টেডিয়ামেই শেষ সবার খেলা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম আর সেবারই শেষ- এক শহরেই সব খেলা।
প্রথম ম্যাচে গ্যালারি ছিল কানায় কানায় ভরা, উরুগুয়ের ম্যাচগুলোতেও একই অবস্থা। কিন্তু অন্যদলগুলোর খেলা ঠিক সেভাবে টানল না দর্শকদের। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল আর্জেন্টিনার খেলাগুলো। মাঠের ফুটবল নয়, বরং বিতর্কের খোঁজেই উরুগুইয়ানরা দেখতে যেতেন আর্জেন্টিনার ম্যাচ।
১৪ জুলাই, ১৯৩০। পরদিন আর্জেন্টিনার ম্যাচে, ফ্রান্সের বিপক্ষে। আগের দিন মন্টেভিডিওর ফরাসি অধিবাসীদের বাস্তিল উৎসব। মাঝরাত পর্যন্ত আতশবাজি ফুটিয়ে সেই উৎসব পালন হল মন্টেভিডিওতে। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে আর্জেন্টিনার হোটেলের সামনের রাস্তায়। রাতে ঘুমটা যে ঠিকঠাক হয়নি আর্জেন্টাইনদের, সেটা বোঝা গেল পরেরদিন খেলার মাঠে। লরেন্টকে শুরুতেই ফাউল করেছিলেন আর্জেন্টিনার লুইস মন্টি। তিনি পুরো ম্যাচ খেললেন খুঁড়িয়ে। বিশ্বকাপের প্রথম গোলদাতা, তাঁকে তুলে নেওয়ার সাহস দেখাননি ফ্রান্স কোচ। এরপর গোলরক্ষকও অসুস্থ হলেন। ৯ জন সুস্থ খেলোয়াড় নিয়েই ফ্রান্সের লড়াই চলল। ৮১ মিনিটে সেই মন্টি ফ্রি কিক থেকে গোল করলে দুর্গ ভাঙে ফ্রান্সের। কিন্তু জবাবটা এরপরও দিয়ে যাচ্ছিল ফরাসিরা। মিনিট তিনেক পরই দারুণ এক আক্রমণ নিয়ে ফ্রান্স চলে গিয়েছিলে আর্জেন্টিনার ডিবক্সের ভেতরও, গোলটাও প্রায় নিশ্চিত। তখনই রেফারি বাজিয়ে দিলেন ম্যাচ শেষের বাঁশি! ঘড়িতে তখন কেবল ৮৪ মিনিট! দুই দল মাঠ ছাড়ার পরে ভুলটা বুঝতে পারলেন রেফারি, আবার ডেকে নিয়ে এসে বাকি ৬ মিনিট খেলালেনও তাদের। কিন্তু ফ্রান্সের সেই তেজ ততোক্ষণে উবে গেছে।
ম্যাচের পর মাঠে ঢুকে গিয়েছিলেন দর্শকেরা, ফ্রান্স খেলোয়াড়দের কাঁধে করে নিয়ে নেচেছিলেনও তারা। আর আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা মাঠ ছেড়েছিলেন দর্শকদের ইট-পাটকেল খেয়ে! বিজয়ীর কেমন দশা!
পরের ম্যাচ ছিল মেক্সিকোর সঙ্গে, রেফারি বলিভিয়ার কোচ উলিসেস সাউসেদো আর্জেন্টিনাকে দিলেন গুণে গুণে ৫টি পেনাল্টি! ওই ম্যাচেই বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন গিলের্মো স্তাবিলে। অথচ তার বিশ্বকাপে খেলারই কথা ছিল না। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ম্যানুয়েল ফেরেরা ছিলেন দলের প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার। তার ল পরীক্ষার সময়ই কী না শুরু হলো বিশ্বকাপ। কী আর করা। অগত্যা পরীক্ষার জন্যই তিনি থেকে গেছেন দেশে। তার জায়গায় নামলেন যিনি তিনিও করলেন হ্যাটট্রিক! বিতর্ক ঘিরে ধরলেও আর্জেন্টিনাকে তাই আটকে রাখা যায়নি। উরুগুয়ের সঙ্গে ফাইনালেও তাই জায়গা করে নিল আর্জেন্টিনা। দুই দলই সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষকে হারাল ৬-১ গোলে। কিন্তু আর্জেন্টাইনরা সেমিতে ফুটবলের সঙ্গে জিতেছে কুস্তিতেও। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের পর যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের কয়েকজন মাঠ ছেড়েছিলেন হামাগুড়ি দিয়ে, কেউ হারিয়েছেন দাঁত, পেট ব্যাথা নিয়ে ম্যাচের পরই একজনকে ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালে।
আর উরুগুয়ে সমর্থকদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে আর্জেন্টিনা দল ততোদিনে হোটেলবন্দী। বিশ্বকাপ শুরুর আগে যে রাস্তায় উৎসব দেখেছিলেন আর্জেন্টাইনরা, ফাইনালের আগে সেখানেই পাহারা দিতে হল পুলিশকে। সাধারণ মানুষের অতি অপছন্দের আর্জেন্টাইনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাদের দায়িত্ব!
৬.
৩০ জুলাই। মন্টেভিডিও। এস্টাদিও সেন্টানারিও।
ফাইনালের দিন সকাল ৯টায় খুলে দেওয়া হলো স্টেডিয়ামের গেট। ১ লাখ মানুষ একসঙ্গে খেলা দেখতে পারেন সেন্টানারিওতে। কিন্তু বিপদের কথা মাথায় রেখে সাত হাজার দর্শক কমিয়ে আনা হলো ফাইনালে। রিভার প্লেট পাড়ি দিয়ে উরুগুয়েতে ঢোকা কয়েক হাজার আর্জেন্টাইন সমর্থকেরাও ঢুকলেন স্টেডিয়ামে।
দুপুর দুইটায় দুই দলকে নিয়ে যখন মাঠে ঢুকলেন রেফারি, গ্যালারির উত্তেজনা ততোক্ষণে স্ফুলিঙ্গ হয়ে গোটা মন্টেভিডিওতে দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছে। খেলাটা আর্জেন্টিনার সঙ্গে, বিপত্তি না বেঁধে উপায় কি? এবার অবশ্য ম্যাচের আগেই ঝামেলা লাগল। কোন বল দিয়ে খেলা হবে বিশ্বকাপ ফাইনাল? আর্জেন্টিনা এতোদিন খেলেছে নিজেদের নিয়ে আসা বল দিয়ে। আর উরুগুয়ের ম্যাচ হয়েছে তাদের বলে। শেষ পর্যন্ত দুই দলকে রাজি করাতে পারলেন রেফারি। প্রথমার্ধ খেলা হবে আর্জেন্টিনার বলে, পরের অর্ধে ব্যবহার হবে উরুগুয়ের বল।
আর বল বদলের সঙ্গে বদলে গেল খেলার ফলও। প্রথমার্ধে ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। পরের অর্ধে উরুগুয়ে ম্যাচটা জিতে গেল ৪-২ গোলে!
ফাইনালের শেষ বাঁশি বাজতেই মাঠের দখল চলে গেল দর্শকদের কাছে। রেফারি আর লাইনসম্যানরা আগে থেকেই নিরাপত্তা চেয়ে রেখেছিলেন, তারা মাঠ ছাড়তে পারলেন ঠিকঠাক। উরুগুইয়ানদের আর ভয় কীসের, নিজেরই তো লোক। আর আর্জেন্টাইনরা যে যার মতো বেরিয়ে পড়লেন মাঠ থেকেই, দিগ্বিদিক। একজন তো সোজা চলে গিয়েছিলেন সমুদ্রপাড়ে, আর্জেন্টিনাগামী জাহাজ ধরতে। কিন্তু উরুগুয়ের বিশ্বকাপ জয় উদযাপনে ব্যস্ত জাহাজের মাল্লারাও। কয়েকদিন তাই জাহাজের ডেকে লুকিয়েই পার করতে হয়েছিল একজনকে।
বিশ্বকাপ জয়ের পরদিন উরুগুয়েতে ঘোষণা করা হয়েছিল সাধারণ ছুটি। আর আর্জেন্টিনায় তখন রাজ্যের নীরবতা। সেই নীরবতা বিস্ফাোরিত হলো ক্রোধে। নিজেদের দলের হার সহ্য করতে না পেরে বুয়েনস আইরেসে আর্জেন্টাইনরা ভাঙচুর করেছিলেন উরুগুইয়ান দূতাবাসে। সেই ঘটনা পরে গড়িয়েছিল আরও বহুদূর।
পুরো টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার খেলার ধরনই বুমেরাং হয়েছিল সেদিন। ফাইনালে উরুগুইয়ানদের মারমুখী আচরণ নিয়ে পরের কয়েকদিন পত্রিকাতেও লেখা হয়েছিল। পরে আর্জেন্টাইনরা খেলোয়াড়রা বলেছিলেন, ম্যাচটা জিতলে হয়ত মাঠ থেকে জীবিতই ফেরা হত না তাদের। মাঠে থাকতেই নাকি তারা আঁচ করতে পেরেছিলেন সেটা। তাই জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারাটাই সেবার বিশ্বকাপের চেয়ে বেশি কিছু নিয়ে ফেরার মতোই দাঁড়িয়েছিল আর্জেন্টাইনদের জন্য।
৭.
ইউরোপের বাকি দেশগুলো বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরেছে ফাইনালের পরই। যেভাবে জাহাজে করে তারা এসেছিল উরুগুয়ে, সেই পথেই আবারও ম্যারাথন যাত্রা। কিন্তু ফেরার সময় ঘটল আরেক ঘটনা। রোমানিয়ার খেলোয়াড় আলফ্রেড ফেরারু লম্বা সমুদ্রযাত্রায় পড়লেন অসুস্থ্য হয়ে। পরে জানা গেল নিউমোনিয়া হয়েছে তার। জাহাজ জেনোয়া পৌঁছানোর পর তাই তাঁকে রেখেই দেশে ফেরার ট্রেন ধরেছিল রোমানিয়া দল।বুখারেস্টে পুরো দলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বয়ং রাজাও। কিং কার্লোর সঙ্গে জড়ো হয়েছিলেন রোমানিয়ার মানুষও। দলের সঙ্গে ফেরারুকে না দেখতে পেয়ে রটে গেল গুজব। মারা গেছেন ফেরারু!
সেই গুজবের মাত্রা এতোই ভয়াবহ ছিল যে ফেরারুর পরিবারও বিশ্বাস করেছিল তাদের ছেলে আর নেই। ফেরারুর বাবা স্মরণসভার আয়োজনও করেছিলেন ছেলের জন্য। কিন্তু জেনোয়ায় ততোদিনে সেরে উঠেছেন ফেরারু। স্মরণসভার আগেই যখন দেশে ফিরে গেলেন, রোমানিয়ানদের সেই উৎসব দেখে মনে হল বিশ্বকাপই বোধ হয় জিতে গেছে তারা!
মন্টেভিডিওর বিশ্বকাপ ততোদিনে কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। অলিম্পিক বাদেও যে কোনো একটা নির্দিষ্ট খেলার আসর নিয়ে এতো হৈ চৈ হতে পারে সেটা প্রথম আসরেই দেখিয়ে দিয়েছিল মন্টেভিডিও। সেই বিশ্বকাপের শতবর্ষ পূরণ হতে বেশিদিন নেই আর। তবুও প্রতি চার বছর পর পর নতুন বিশ্বকাপ এলেই যেন আরও একবার ফিরে আসে মন্টেভিডিও। সবকিছুর শুরুটা তো সেখান থেকেই!
রিফাত মাসুদ