নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, গাধার পিঠে উল্টো হয়ে বসা সুপরিচিত রসিক লোকটি, যার “স্বত্ব” দাবী করে তুরস্ক, আফগানিস্তান, ইরান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, এমনকি চীনও। বহু-মালিকানা সূত্রে তার কবরও পাওয়া যাবে দেশে-বিদেশে। হোজ্জা নাকি তার কবর কেমন হবে সেটা নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তৈরি হয়েছিল সেই মত- উঁচু দেয়াল, মোটা ফটকে ভারি তালা ঝুলানো, অতি সুরক্ষিত কবরখানা। কোনো ভক্ত পর্যটক যদি তার কবর দেখতে যান তবে নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে। তিনি যদি অতি উৎসাহী হন, চারপাশটা ঘুরে দেখেন তবে দারুণ জিনিস আবিস্কার করবেন। সামনে উচু দেয়াল হলেও পেছনের তিন দিকেই হাটু সমান উঁচু দেয়াল কবরকে ঘিরে রেখেছে যা সহজেই টপকানো যায়। বিদগ্ধরা বলেন হোজ্জা মরে গিয়েও পৃথিবীর মানুষকে একটা এসএমএস (বার্তা) দিতে চেয়েছেন তার পদ্ধতিতে। বাংলাতে একটা কথা আছে, “মানুষের সামনে দিয়ে দুই টাকা গেলে কামড়ে ধরে, পেছন দিয়ে বস্তা ভর্তি চলে গেলেও পাত্তা দেয় না”, হোজ্জার বার্তাটা ঠিক এটাই। তুরষ্কের আকশিরে তার একটা কবর আছে, সেটি দেখিয়ে তুর্কিরা বেশ পয়সা কামাই করে। যদি কোনো দিন দেখার সুযোগ হয় তবে জানতে পারব কথাটা সত্য কিনা নাকি হোজ্জার আরেকটা গল্প নাকি তার অন্য কোনো কবর।
চীন-য়ুউরোপ যখন করোনায় পুড়ে বাঙালি তখন ভেবেছিল করোনাভাইরাস দেশে আসবে না। যখন এসে গেলে তখন ভেবেছিল আর সবার হলেও আমার হবে না। করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা যখন ৮০ হাজার ছাড়িয়ে (লেখা যখন শুরু করেছি তখন ৬০ হাজার ছিল), অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাঙালি এখনও ভাবছে “আমার হবে না”। কিন্তু মানুষ সতর্ক হচ্ছে, খুব সতর্ক! কে আক্রান্ত হয়েছে শুনল, তার বাড়ি গিয়ে ভাংচুর করল, দরজায় তালা মেরে দিল, যে চিকিৎসক-নার্স রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছে না, এলাকায় হাসপাতাল বানাতে দিচ্ছে না, এলাকায় কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র বানাতে দিচ্ছে না, রোগী মরে যাচ্ছে আত্মীয়রা ফেলে যাচ্ছে, রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে জরুরি চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে, এক মাসের যায়গায় তিন মাসের খাবার কিনে বাজারে সংকট তৈরি করেছে! মৃত মানুষের নিঃশ্বাস নেই, প্রশ্বাস নেই, হাঁচি নেই, কাঁশি নেই, ভাইরাস ছড়ানোর রাস্তাগুলো বন্ধ তারপরও এলাকার কবরস্তানে তাকে কবর দিতে দেন নি। সামনের দিকে সতর্কতার এতো উঁচু দেয়াল তুলেই বাঙালি নিশ্চিন্ত!
কিন্তু করোনাভাইরাসের জন্য পেছনে তিন দিক ঠিকই খোলা আছে! লকডাউনের প্রথম দিনগুলো যখন সত্যিকারের সতর্কতা ভাইরাসের প্রসার ঠেকিয়ে দিতে পারত সেই সময় মানুষের সবকিছু ভাল লাগত শুধু ঘর ছাড়া। লকডাউনের অভিনয় শেষে আশি হাজার আক্রান্ত আর এগারশ’ মৃত্যুর পর এখনও অনেকে করোনাভাইরাস বিশ্বাস করেন না।
যার সপ্তাহে এক বা দুই দিন বাজারে গেলে চলে তিনি ঐহিত্য বজায় রাখতে প্রতিদিন বাজারে যাচ্ছেন, পরিবার-বাচ্চাকাচ্চার বিশাল বহর নিয়ে কেনাকাটা করছেন, ঘরে ভাল লাগে না বলে সড়কে গিয়ে হাটাহাটি করছেন, পাশের বাড়ী ঢু মারছেন, যেখানে না গেলেও চলে সেখানে বেড়াতে যাচ্ছেন, বন্ধুরা মিলে খোলা মাঠে আড্ডা দিচ্ছেন- খোলা মাঠে কোনো বন্ধু ভাইরাস নিয়ে গেলে যেন সেখানে ছড়াবে না!
চাকুরি, ব্যবসায়, জীবীকার জরুরি প্রয়োজনের পরেও স্বাভাবিক চলাফেরায় খুব একটা ছাড় দেন নি, যে কাজগুলো করলে ভাইরাসের প্রবাহ সীমিত থাকত সেগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। বাজারের সব হ্যান্ডওয়াশ আর স্যানিটাইজার কিনে ভেবেছেন নিরাপদ থাকা যাবে- এই হল বাঙালির সতর্কতা।
পারভেজ রবিন
www.pervezrob.in