নাজিম হিকমত: জেলখানার কবি

1956

জেলখানার কবি তিনি। সারাটা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই করে গেছেন, জ্বালাময়ী সব কবিতা লিখেছেন, আন্দোলন করেছেন। মানুষের অধিকার আদায় আর শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে।

এই জেলখানার কবির নাম নাজিম হিকমত, জন্ম তুরস্কে। কিন্তু তিনি শুধু তুরস্কের কবি নন। তিনি পৃথিবীর সমস্ত শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কবি। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর নানা দেশে, নানান ভাষায়। বাংলাদেশে নাজিম হিকমতের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। কবিতা ভক্তদের কাছে অসম্ভব প্রিয় তিনি। তাঁর ‘জেলখানার চিঠি’ কবিতাটি তো মনে হয় অনেক কবিতা প্রেমীরই মুখস্থ। প্রায় সব আবৃত্তিকারই তাঁর কবিতা আবৃত্তি করার জন্য রীতিমত মুখিয়ে থাকেন।


ছোট বেলায় নাজিম হিকমত

বাংলাতে নাজিমের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতার অনুবাদ করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যের যে কোন শাখার অনুবাদই অসম্ভব রকমের দুরূহ এক কাজ। এক ভাষায় যে জিনিষ অসম্ভব আকর্ষণীয়, উপভোগ্য, অন্য ভাষায় রূপান্তরের পরেই তা প্রায়শই হয়ে পড়ে একেবারে পানসে ধরনের। সাহিত্যের অন্য যে কোন শাখার চেয়ে কবিতার ক্ষেত্রে এই অবনমন হয় সবচেয়ে বেশি। অনুবাদ দিয়ে আসল কবিতার আসল রূপরস ছন্দের সামান্য একটু অংশই পাওয়া যেতে পারে মাত্র। তার বেশি আশা করাটা একেবারে বাতুলতা মাত্র। বিভিন্ন লেখকের করা হিকমতের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে দেখেছি। বড়ই বিবর্ণ সেগুলো। সেই তুলনায় নাজিমের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সকল আশা প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। নিজে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবি হবার কারণে তার অনুবাদ মৌলিক কবিতার অসামান্য শৈল্পিক স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। এরকম উচ্চ মানের অনুবাদ করতে শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ কবিই পারেন আরেকজন শ্রেষ্ঠ কবির কবিতার ক্ষেত্রে। আশ্চর্য হতে হয় যখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, ‘নাজিমের কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল আমার কবিতার অনুবাদের হাতে খড়ি’।

অন্য খবর  ট্রেইনি চিকিৎসকরা শহীদ মিনারে অনশনে


কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়

১৯০২ সালে তুরস্কের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নাজিম হিকমতের জন্ম। অল্প বয়স থেকেই কবিতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র সতের বছর বয়সে তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মিত্রবাহিনী অধ্যুষিত তুরস্ক ছেড়ে মস্কো চলে যান তিনি। এ সময়ে রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। হিকমত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তার কবিতা আরও জোরালো ও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ১৯২৪ সালে তুরস্কের স্বাধীনতার পর তিনি ফিরে আসেন। একটি বামপন্থী পত্রিকায় কাজ করার অপরাধে তিনি গ্রেপ্তার হন। কিন্তু হিকমত মস্কোয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং সেখানে কবিতা এবং নাটক লিখতে থাকেন। ১৯২৮ সালের এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কারণে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। কম্যুনিস্ট পার্টি ততদিনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণই সাদা পোশাকের পুলিশের লোকজন তাকে নজরদারিতে রাখতো। পরের দশ বছরের পাঁচ বছরই তিনি নানান ধরনের বিচিত্র সব হাস্যকর অপরাধের অভিযোগে জেলখানায় কাটান। কিন্তু এই দশ বছরেই তিনি সুদীর্ঘ কবিতাসমৃদ্ধ চারটি বইসহ সর্বমোট নয়টি কবিতার বই প্রকাশ করেন। এই সমস্ত কবিতা তুরস্কের কবিতায় বিপ্লব সাধিত করে। তুরস্কের প্রধানতম কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তিনি।


জেলখানাতেই জীবনের বহু সময় পার করেছেন

১৯৩৮ সালে আবার তাকে যেতে হয় জেলে। এবার অভিযোগ তুরস্কের সামরিক বাহিনীকে বিপ্লবে উস্কানি দেয়ার। তার অপরাধ ছিল তার দীর্ঘ কবিতা গুলো মিলিটারি ক্যাডেটরা পড়ছে এবং এতে করে তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জন্ম নিচ্ছে।এ দফায় ২৮ বছরের সাজা দেয়া হয় তাকে।

১৯৪৯ সালে পাবলো নেরুদা, পল রবসন এবং জ্যা পল সার্ত্রে প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল হিকমতের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৯৫০ সালে পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার জিতে নেন। এই বছরেই আঠারো দিনের আমরণ অনশনে যান তিনি। তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসায় মুক্তি পান।

অন্য খবর  উচ্চাভিলাষী কিশোরের আত্মহত্যা; বন্ধুদের ধিক্কার

দুই কালজয়ী নাযিম হিকমত ও পাবলো নেরুদা

এতো বার জেলে যেয়েও যন্ত্রণার অবসান ঘটে না তার। দুই দুইবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পঞ্চাশ বছর বয়সে রাশিয়ান সীমান্তে সামরিক দায়িত্ব পালন করানোর চেষ্টা করা হয় তাকে দিয়ে। এই সব যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ছোট্ট একটা মোটর বোটে করে বসফরাস প্রণালী পাড়ি দিয়ে বুলগেরিয়া হয়ে রাশিয়াতে পালিয়ে যান তিনি। পরের বছরই তুরস্ক সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। ১৯৬৩ সালে ৬১ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান কবি।

ইতিহাসের কী চরম লীলাখেলা। পঞ্চাশ বছর আগে যাকে বিশ্বাসঘাতক বলে রায় দিয়ে নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল তুরস্ক সরকার তাকেই আবার সসম্মানে মরণোত্তর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। ২০০০ সালে পাঁচ লাখ তুর্কী নাগরিক সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল নাজিম হিকমতের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য এবং তার দেহাবশেষ মস্কো থেকে তুরস্কে ফিরিয়ে আনার জন্য। আর সে আবেদনে সাড়া দেয়া ছাড়া তুরস্ক সরকারের কিছু করারও ছিল না। নাজিম হিকমতের তুরস্ককে কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু তুরস্কের নাজিম হিকমতকে যে বড়ই প্রয়োজন।

নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তুরস্কের ডেপুটি মিনিস্টার কেমিল সিচেক বার্তা সংস্থা এপিকে জানান যে, নাজিম হিকমতের বিষয়ে সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের এটাই সময়। যে অপরাধের জন্য সরকার তার নাগরিকত্ব সেই সময়ে বাতিল করেছিল, সেই অপরাধ এখনকার যুগে আর কোন ধরনের অপরাধের পর্যায়েই পড়ে না।

এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন অমর সব কাব্য। যা আজও শোষিত মানুষের মুক্তির গান গায়।

ছবি: নিয়নআলোয়

আপনার মতামত দিন