প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর নিজ এলাকার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পড়তে চায় ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার শিক্ষার্থীরা। এই উপজেলায় ৪০টির মতো বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে। কিন্তু একটিও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা কলেজ নেই। ১০০ ও ৫০ বছরের পুরোনো দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেগুলো সরকারীকরণ হয়নি।
নবাবগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমদ বলেন, উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩২। পাঁচটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও তিনটি স্বতন্ত্র কলেজ আছে। স্কুল অ্যান্ড কলেজগুলোর তিনটি এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত)।
সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী, যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সেখানে একটি করে বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারি করা হবে।
গত ১৩ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৭৯টি বিদ্যালয় সরকারি করার জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরে তালিকা পাঠিয়েছে। কিন্তু এতে নবাবগঞ্জের কোনো প্রতিষ্ঠান স্থান না পাওয়ায় হতাশ এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।
এলাকাবাসী বলছেন, নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়টি ১০৯ বছরের পুরোনো। আর দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজটি ৫০ বছর পার করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটির শিক্ষার মানও ভালো। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হলে এলাকার ছাত্রছাত্রীদের অনেক সুবিধা হতো। এখন অনেক বেতনে তাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়তে হচ্ছে।
উপজেলার সমসাবাদ এলাকার মো. মোতালেব বলেন, রাজধানীর কাছে ঢাকার একটি উপজেলা হওয়া সত্ত্বেও এখানে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই। উপজেলায় শিক্ষার হার ও মান বাড়াতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই।
নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিদ্যালয়টির পাসের হার ৯৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। ১১ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। বছর তিনেক আগে এখানে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি খোলা হয়।
গত সপ্তাহে পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক তাঁর অফিসে বসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখছেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ অফিসে এসে দেখে যাচ্ছেন তাঁদের ক্লাসের সময়সূচি। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যাতে বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য মূল ফটকে পাহারার ব্যবস্থা আছে।
সহকারী প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৪৩ জন শিক্ষক পড়ান। শিক্ষার্থী প্রায় দুই হাজার। ২০০৭ সালে মডেল প্রকল্পে নেওয়া হয়। কিন্তু এরপর নয় বছরেও সরকারি করা হয়নি।
দশম শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী জয়ন্ত দাস ও মানবিক বিভাগের তাজরিন আক্তার বলল, বিদ্যালয়টিতে পড়ে তারা গর্বিত। এখান থেকে অনেক ভালো শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে বের হয়। এই বিদ্যালয়টি তারা থাকতেই সরকারি হলে তাদের গর্ব আরও বেড়ে যেত। শিক্ষার সুযোগও বাড়ত।
বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক শাহাবুদ্দীন আলম বলেন, ২৬ বছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হবে—এটা তাঁর অনেক দিনের আশা। কিছুদিন আগেও কয়েকটি বিদ্যালয় সরকারি হয়েছে, সেখানে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম না থাকায় তিনি খুবই মর্মাহত।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯০৫ সালে। উপজেলার তিন সমাজসেবক নারায়ণ চন্দ্র রায়, রাসবিহারী সেন ও আবদুল হক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়ে পাঁচতলার একটি আধুনিক ভবন থাকলেও অধ্যক্ষ যে ভবনে বসেন, সেটি বেশ পুরোনো।
দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ: উপজেলা সদরের সমসাবাদ এলাকায় ১৯৬৫ সালে প্রায় সাত একর জায়গা নিয়ে দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি ও স্নাতক মিলিয়ে প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস আছে। শিক্ষকদের জন্য কলাকোপা বাজারের কাছে আছে আবাসিক ভবন।
পরীক্ষার ফলের দিক থেকে কলেজটি উপজেলার অন্যান্য কলেজের তুলনায় এগিয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ২০১৩ সালে মোট পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ, পরের বছর ছিল ৮৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে গত বছর হঠাৎ ধস নেমে পাসের হার ৫৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে দাঁড়ায়।
সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ মানবেন্দ্র দত্ত বললেন, এ বছর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়টি প্রথম খোলা হয়। তখন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও ভালো শিক্ষক পাওয়া যায়নি। মূলত ওই বিষয়েই বেশি শিক্ষার্থী খারাপ করেছে।
কলেজ সূত্র জানায়, কলেজের একজন শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন ২৫০ টাকা। ডিগ্রি শ্রেণিতে ৩০০ টাকা এবং সম্মান পর্যায়ে ৬০০ টাকা মাসিক বেতন। তবে গরিব, অসচ্ছল, উপবৃত্তিপ্রাপ্ত, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হয় না।
অভিভাবক আফতাব উদ্দিন বলেন, উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। সরকারি স্কুল-কলেজ থাকলে গরিব মেধাবীরা উপকৃত হতো।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল বাশার বলেন, ‘আমাদের কলেজ প্রথম সারির হওয়া সত্ত্বেও একে সরকারি করা হয়নি। আশা করছি, সামনে সরকারি কলেজের তালিকায় কলেজটি স্থান পাবে।’
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো. ইউসুফ হোসেন বললেন, তিনিও দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজে পড়েছেন। এখানে যত শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে, উপজেলায় আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এত শিক্ষার্থী নেই। কলেজটি সরকারি হলে শিক্ষার মান বাড়বে।
নবাবগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ফারুক আহমদ বলেন, দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ এবং নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়—এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারীকরণের সুপারিশ করা হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠানই যেকোনো পর্যায়ে সরকারি হবে বলে তিনি আশা করছেন।