ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা-বান্দুরা অঞ্চলের স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্ব আছে৷ এ অঞ্চলে কয়েক’শ বছরের পুরনো শত শত দালান সেই সময়ের স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ হয়ে আজও টিকে আছে৷ এই দালানগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন উপকথা ও কুসংস্কার৷
দালানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত খেলারামদাতার কোঠা, যা স্থানীয়দের কাছে আন্ধারকোঠা বা ভূতের বাড়ি হিসেবে পরিচিত এই দালানকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কাহিনী প্রচলিত আছে৷ তবে দলানের আবির্ভাব নিয়ে ৩টি ভিন্নধর্মী কাহিনী প্রচলিত আছে৷ অনেকের মতে এটি গায়েবি ভবন যা রাতারাতি তৈরি হয়েছে৷ পাশে থাকা পুকুরটি নিয়েও অনেক অলৌকিক কাহিনী আছে৷ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কাহিনীটি রইল পাঠকদের জন্য।
ঢাকা জেলার সদর দক্ষিণ মহকুমায় অবস্থিত কলাকোপায় এক বনিক পরিবারে জন্ম নিয়েছিল খেলারাম৷ ছোটকালে পিতা মারা যাওয়ায় মায়ের আদরে বড় হওয়া তার৷ তবে দিনে দিনে অবাক লক্ষণই ছেলের মাঝে প্রকাশ পায়৷ কিশোর খেলারাম প্রায়ই ছুটে গিয়ে বসে থাকত অদূরের প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীরে৷ বয়ে যাওয়া স্রোত এবং বিশাল বিশাল সব ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে তার শুধু ইচ্ছে হতো নৌকায় চেপে ভেসে বেড়াতে৷ একদিন বিধবা মা টের পেয়ে প্রশ্ন তোলেন, “নদীর দিকে ফিরে তুই এত কি খুঁজিস?” খেলারাম হেসে উত্তর দিল, “আমার শুধু ভাবনা এই নদী কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে?” প্রত্যুত্তরে বিধবা বলেন, “বাপ-দাদাদের মুখে শুনেছি নদীর শেষ সমুদ্রে৷ গিয়ে দেখ পথ ঘুরে ঘুরে আমাদের পদ্মাও তেমন গিয়ে মিশেছে অকূল কোন সমুদ্রের গায়ে৷ তবে তা কি আমাদের কোনো দিন দেখতে পাওয়ার আর?” বড় হয়েও খেলারাম নদীর নেশা ছাড়তে পারে না৷ বংশের অন্যরা চাষাবাদ, ব্যবসায় লেগে থাকলেও সে শুধু শোনে পদ্মার ডাক৷ যেন ফিসফিস স্বরে ওই নদী বলে, “চলো, চলো, সমুদ্র দেখবে যদি, ভাসো আমার বুকে!”
অবশেষে পুত্র একদিন আপন অভিলাষ মায়ের কাছে ব্যক্ত করে৷ খেলারামের আশঙ্কা ছিল একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাকে বাড়ির বাইরে দূরে কোথাও যেতে দেওয়া হবে না৷ কিন্তু বিধবা শোনালেন অন্য কাহিনী৷ বললেন, “জানিস বাবা, আগে এলাকার অনেক মানুষ দাড় টানতে পদ্মায় চলে যেত৷ তোর দাদার বাপ-দাদারাও ডিঙি ভাসিয়ে কত দূর দূর দেশে বানিজ্য করতে গেছে৷ এখন কি আর সেসব আছে!” ছেলে ব্যাগ্রভাবে শুধোয়, “কেন মা, নেই কেন?” উত্তরে তিনি জানালেন, এ দেশের রাজা শশাঙ্ক গৌড় আইন করে মানুষের সমুদ্রে যাওয়া নিষেধ করে দিয়েছিলেন৷ আর কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে তাকে জাতে পতিত করা হতো৷ কপালে জোটত মেথর কিংবা অন্য কোন ছোট মাপের চাকরি৷ রাজার এই নিষ্ঠুরতার কারনে বন্ধ হয়ে যায় সব সওদাগরি ব্যবসা৷ থামে বহু মানুষের রুটি-রুজির উপায় দাঁড়টানা কাজ৷ হাজার হাজার নৌকার মিস্ত্রিও তাতে বেকার জীবনের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়৷ কাহিনী শুনে ছেলে জবাব দেয়, “মা, রাজা শশাঙ্ক তো এখন আর বেঁচে নেই৷ তুমি অনুমতি দিলে আমি সমুদ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে রাজার নিয়ম ভাঙতে পারি৷”
খেলারামের এই আবেদনে বিধবা সাড়া দেন৷ মায়ের অনুমতি পেয়ে ছেলে দূরের শাল গ্রাম থেকে মিস্ত্রি এনে নৌকা তৈরি করে৷ জোগার হয় মাঝি-মাল্লার দল৷ শুভদিন দেখে যাত্রা শুরু হলে মা এসে গলুইয়ের মুখে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিয়ে পুত্রের মাথায় রাখেন আশীর্বাদের হাত৷ তারপর বানিজ্যের বেসাত নিয়ে খেলারাম ডিঙা ভাসায় পদ্মার স্রোতে৷ গিয়ে পৌঁছে মালয় উপদ্বীপে৷ সেখানে বয়ে নেওয়া পণ্য বিক্রি করে প্রচুর মুনাফাহয় তার৷ তা দিয়ে নতুন কেনাকাটা করে সে যায় শ্যামদেশে৷ একদিন লাভ নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসলে মা আদেশ করেন, “যা পেয়েছিস তা থেকে একভাগ গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দে৷” পালিত হয় মাতৃআজ্ঞা৷
অবশিষ্ট দু’ভাগ দিয়ে খেলারাম সাজায় সাত-সাতটা ডিঙি৷ এবারে সে শ্যাম, মালয়, সুমাত্রা, যবদ্বীপের বন্দরে বন্দরে মাল বেচাকেনা করে ফিরে আসে এক ডিঙি ভরা টাকাকড়ি নিয়ে৷ বিধবা এবার অর্জিত ধন-সম্পদের অর্ধেক গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে বলেন৷ ইতোমধ্যে দূর-দূরাঞ্চলেও খেলারামের মহানুভবতার কথা ছড়িয়ে পড়ে৷ তার দেখাদেখি রাজা শশাঙ্কের আইন অমান্য করে অন্যরাও নৌপথে বাণিজ্য শুরু করে৷ এদিকে বাণিজ্যের ধন দিয়ে খেলারাম গড়ে তোলে বিশাল প্রাসাদ, যা আজ খেলারামদাতার কোঠা হিসেবে পরিচিত৷ সেখানে বসেই প্রতিবারের লাভ সে বিলিয়ে দিত দুস্থ মানুষের মাঝে৷
একবার মা তাকে বললেন, “ছেলে রে, এ বছর আমার সাতার কেটে আম খাওয়া হলো না৷” এই কথা শুনে ছেলে গোপনে বিরাট এক পাকা চৌবাচ্চা তৈরি করল৷ আশি মণ গরুর দুধ কিনে জ্বাল দিয়ে ঢালা হলো তাতে৷ জড়ো করা হলো ঝুড়ি ঝুড়ি আম৷ আমে দুধে একাকার হয়ে গেল চৌবাচ্চা৷ এরপর খেলারাম মাকে ডেকে আনে আম খেতে৷ ছেলের পাগলামিতে মা চমকে যায়৷ পরবর্তীতে আম-দুধ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়৷ পরদিন খেলারাম বেলা হয়ে যাবার পরও ঘুম থেকে উঠল না৷ মা তাকে ডেকে তুলল৷ শরীরে জ্বর-টর কিছু নেই৷ মা বলল, “যা, তাড়াতাড়ি ডুব দিয়ে আয়৷ আমি তোর জন্য কত কি পিঠা বানিয়ে বসে আছি৷” খেলারাম সেই আদেশ মেনে নিয়ে ডুব দেয় পুকুরের জলে৷ অনেক সময় কেঁটে গেলেও সে উঠে না৷ বিষয়টি বুঝতে পেরে ঘাটলায় দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে ঝাপ দেয় পুকুরে৷ তুলে আনে খেলারামের মৃতদেহ৷ দাতা খেলারামের মৃত্যুতে কান্নার রোল উঠে চারদিকে৷ সবচেয়ে মর্মভেদী ঠেকে মায়ের কান্না৷
তিনি চিৎকার করেন, “এ কি করলে ভগবান? আমার খোকাকে কেন তুমি নিয়ে গেলে?” এ সবই আজ থেকে পাঁচশ বছর আগের কথা৷ কালের স্রোতে ক্ষয়ে গেছে খেলারামের ভিটেবাড়ি৷ সম্প্রতি বহু কারুকার্যখচিত দালানের ধ্বংসাবশেষকে সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রাতের বেলা এই পথ দিয়ে চলতে গিয়ে পথিক নাকি আজও শুনতে পায় সেই মায়ের গুমরে ওঠা কান্না৷৷
এছাড়াও প্রচলিত আরো কাহিনী রয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এক রাতে এই বিশাল ভবনটি মাটি ভেদ করে উঠতে থাকে, হটাৎ কেউ একজন দেখে ফেলায় এটার ওঠা বন্ধ হয়ে যায় এবং কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে পুনরায় মাটির নিচে ডেবে যেতে থাকে। এটি যখন উঠেছিল তখন ৭/৮ তলা ছিল বলে স্থানীয়রা জানান যা বর্তমানে একতলা। তবে কি মাটির নিচে আরো তলা রয়েছে?
সবচেয়ে রহস্যের বিষয় হচ্ছে এর ভেতর প্রচন্ড অন্ধকার যা কল্পনার অতীত। অনেক আগে কয়েকজন ভবনের নিচে যাওয়ার চেষ্টা করেও যেতে পারেননি বলে কথা প্রচলিত আছে। এমনকি এরও আগে কয়েকজন নিচে গিয়ে আর নাকি ফেরত আসেনি। স্থানীয়দের এমন কথার যথার্থতা কতটুকু তা বিচার করা দুষ্কর।