দোহার-নবাবগঞ্জের সামাজিক অসংগতি–২: দায়ী অভিভাবক, পর্নোআসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ংকর

1761
পর্ন আসক্তি

যার যে বয়স নয় সে বয়সে পরিণত বয়স্কদের উপযোগী মোবাইল ফোন, টেলিভিশন বা বিভিন্ন পর্ণ বই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে দোহার-নবাবগঞ্জের যুবকদের। সবচেয়ে আতংকের বিষয়টি স্কুল-কলেজগামী ছেলেদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে বরংচ মেয়েরা।

অতি আধুনিকতার নামে বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের আইটেম সং বা ফ্যাশন উত্তেজক টেলিভিশন চ্যানেল বাড়ীতে সবাই এক সাথে দেখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যেন কোন রাখ ঢাক নেই। এছাড়া ইণ্টারনেট সেবা আজ কুফল হয়ে দেখা দিয়েছে। পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, সমাজ ও লোক চক্ষুর অন্তরালে ঘটছে ব্যাভিচারের মতো ঘটনা। বাড়ছে পরকীয়া ও অশ্লীলতা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের পরিচালিত একটি নমুনা জরিপে শিক্ষার্থীদের পর্নো আসক্তির ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাহি নিউজ৩৯-কে  জানান, তিনি রাজধানীর ঢাকার একটি স্কুলে নবম শ্রেণীর একটি কাসে যান যেখানে মোট ৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তাদের মধ্যে ২৯ জনের কাছে মোবাইল পাওয়া যায়। এদের ২৫ জনের মোবাইলেই পর্নোগ্রাফি পাওয়া যায় এবং তারা অনেকে কাসে বসেই পর্নোগ্রাফি দেখে।

এর আগে ২০১৩ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় রাজধানীর ৭৭ ভাগ কিশোর পর্নোভিডিও আসক্ত। আর সবারই ধারণা দোহার-নবাবগঞ্জে এ হার অনেক বেশি। শুধুমামত্র অভিভাবকদের ভুলে ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারনে এমনটি ঘটছে। অধিকাংশ অভভাবকেরা জানেন না যে, তার সন্তান আসলে প্রযুক্তির কি ধরনের ব্যবহার করছে।

পর্নো আসক্তি বিষয়ে সম্প্রতি অতি গোপনে দোহারের একটি স্কুলের দশম শ্রেণীর ৩৭ জন  শিক্ষার্থীর মোবাইল পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৬ জনের মোবাইল রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জন মোবাইলের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি দেখেছে বলে জানিয়েছে। এদের মধ্যে ১২ জনই আবার কোনো না কোনো সময় কাসে বসেও পর্নোগ্রাফি দেখার কথা জানায়।

পর্নোগ্রাফি বর্তমানে এমন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে যে, অনেকে তা প্রকাশ্যে দেখতেও আর রাখঢাক করছে না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সাথে আলাপকালে তাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন অনেক সময় শিক্ষক কাসে না থাকলে  মোবাইলে আর বিকালে বন্ধুর বাড়ীতে মোবাইল বা ল্যাপটপে পর্নো দেখা শুরু করে।

এ ব্যাপারে এক গার্লস স্কুলের শিক্ষক নাম না প্রকাশ শর্তে বলেন, একদিন তিনি শেষ বেঞ্ছের দিকে কয়েকজন ছাত্রীকে অমোনযোগী দেখতে পান। তিনি তাৎক্ষণিক তাদের কাছে পৌঁছলে এক জনের হাত থেকে মোবাইল ব্যাগে ঢুকানোর সময় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে পড়ে যায়। তিনি মোবাইলটি হাতে নিলে সেখানে স্থির পর্ণ চিত্র দেখতে পান। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদেরকে ক্লাশ থেকে বের করে দেন বলে জানান। এদের মাঝে ক্লাশের মেধাবী ছাত্রীও ছিল বলে জানান তিনি।

ডিজিটাল অ্যানালিস্টস জুনিপার রিসার্চ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে ২০১৫ সালে প্রাপ্তবয়স্ক স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা গড়ে ৩৪৮টি করে পর্ন ভিডিও দেখবে। তাদের ডিভাইস থেকে এ বছরে মোট ১৩৬ বিলিয়ন পর্ন ভিডিও দেখা হবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

স্কুল শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল থাকলেও অনেকের ইন্টারনেট সংযোগ নেই। তাই তারা দোহার-নবাবগঞ্জের বিভিন্ন মার্কেট থেকে পর্নোভিডিও ডাউনলোড করিয়ে আনে নতুবা যাদের কাছে আছে তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। আর যাদের ইন্টারনেট আছে তারা ইচ্ছা মতো পর্নোভিডিও ডাউনলোড করে নেয়।

অন্য খবর  নবাবগঞ্জে নির্ধারিত সময় পর দোকান-পাট খোলা রাখলে কঠোর ব্যবস্থা: সালাউদ্দিন মনজু

শিক্ষক, অভিভাবক, দোকানদার এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সুযোগ পেলেই একা একা এমনকি কয়েকজন মিলে অসঙ্কোচে তারা পর্নোভিডিও দেখে থাকে। দোহার-নবাবগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের শিক্ষার্থী তরুণদের মধ্যেও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে পর্নো আগ্রাসন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ভিডিও দোকানে এসব ডাউনলোড করার জন্য। এমনকি পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মোবাইলেও পর্নোগ্রাফি ধরা পড়ার খবর বেরিয়েছে। দোহার-নবাবগঞ্জের গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে ১০ টাকায় মিলছে মোবাইল ভর্তি পর্নোগ্রাফি।

নবাবগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন মোবাইল দোকানদার জানিয়েছেন, মোবাইলে বিদেশী পর্নোগ্রাফির চেয়ে দেশী পর্নোগ্রাফি বেশি চলে। ধর্ষণের দৃশ্য, গোপনে ধারণ করা বিভিন্ন দৃশ্য, বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মডেল অভিনেত্রীদের গোপন স্ক্যান্ডালের নামে পর্নোগ্রাফি বেশি চলে এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাই এগুলো বেশি নিচ্ছে। তা ছাড়া প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে সাইবার ক্যাফে ঢাকা থেকে বিদায় নিয়েছে; কিন্তু এর কদর রয়েছে এখনো। স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে দেখছে বিদেশী পর্নোগ্রাফি।

পর্নোগ্রাফি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রাম-শহর সর্বত্র মা-বাবার একই চিন্তা, কিভাবে সন্তানকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এক সময় মা- বাবার দুশ্চিন্তা ছিল নিরাপত্তা, মাদক, খারাপ বন্ধুবান্ধব ও পরিবেশ, সন্ত্রাস, বখাটেপনা থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং এর খারাপ প্রভাব নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এখন ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব দুশ্চিন্তার মাত্রা।

মান-সম্মানের স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক কেঁদে  জানান, তার দশম শ্রেণী পড়–য়া ছেলে প্রায়ই বন্ধুদের সাথে নিয়ে ছাদে গিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখছে। এক দিন ছাদের গেট খোলা রেখে তারা পর্নো দেখার সময় একজন ভাড়াটিয়া সেখানে গিয়ে এ দৃশ্য দেখে তাদের জানিয়েছেন। তিনি জানান, কিভাবে ছেলের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করব এবং কিভাবেই বা এর প্রতিকার করব তা বুঝে উঠতে পারছি না। বিষয়টি খুবই বিব্রতকর।

গবেষণায় পর্নো আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেরোইন আসক্তিকেও হার মানায়। মাদক গ্রহণ যেমন মানুষের মধ্যে নেশা বা আসক্তি হিসেবে কাজ করে তেমনি পর্নোগ্রাফিও আসক্তি হিসেবে কাজ করে মন-মস্তিষ্ক ও দেহে। মাদকাসক্ত থেকে যেমন অনেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জাড়িয়ে পড়ে তেমনি পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকেও নানা ধরনের অপরাধের জন্ম নিচ্ছে। আসক্তদের মধ্যে দেখা দেয় নানা ধরনের বিকৃতি। এর প্রভাবে ব্যক্তি, পরিবার এবং সামাজিক জীবনে দেখা দেয় নানা বিপর্যয়।

সম্প্রতি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পর্নোগ্রাফি আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণত ১৩ বছরের কিশোররা ইন্টারেনট পর্নোতে বেশি আগ্রহী এবং তারা মেয়েদেরকে যৌনতার একটি বিষয় হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করে। প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয় , নিষ্পাপতার দিন শেষ হয়ে গেছে। মানুষ এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক কিছুই জানতে পারে। এটা হচ্ছে ঘরে হেরোইন রেখে শিশুকে ছেড়ে দেয়ার মতো। কিছু ডাক্তার অবশ্য বলেছেন, যারা অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তারা মাদকাসক্তদের চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে আছে। প্রমাণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী জেফরি সেটিনোভার বলেন, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে পর্নোগ্রাফির কেমিক্যাল আসক্তি হেরোইনের মতোই। শুধু প্রয়োগটা ভিন্ন।গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তাদের মস্তিষ্কে মাদকাসক্তদের মতোই নেশা কাজ করে। মাদক গ্রহণের ফলে আসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের যে অংশে অনুভূতি কাজ করে ঠিক সেই অংশই উদ্দীপিত হয়ে ওঠে আসক্তরা যখন পর্নো দেখে।

অন্য খবর  দোহারের এসি ল্যান্ড জ্যোতি বিকাশের পক্ষ থেকে বিদায়ী ইউএনও কে শুভেচ্ছা

মাদকাসক্তদের যেমন স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে, বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা নেমে আসে তেমনি পর্নো আসক্তরাও ধীরে ধীরে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে এবং বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। তাই তরুণসমাজকে রক্ষায় ক্ষতিকর ওয়েবসাইট বন্ধের জন্য যুক্তরাজ্য সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। পর্নোগ্রাফি এবং পর্নো আসক্তি নিয়ে সারা বিশ্বে নানা ধরনের গবেষণা এবং সমীক্ষা চলছে। তুলে ধরা হচ্ছে এর ক্ষতিকর দিক।

এক দিকে যেমন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে পর্নো অন্য দিকে কেউ কেউ এর বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি পর্নোগ্রাফিতে অভিনয়ের জগৎ থেকে ফিরে এসে কেউ কেউ জনসমক্ষে তুলে ধরছেন অন্ধকার জগতের কথা। তাদের মতে অনেকে পর্নোজগৎকে স্বেচ্ছায় বেছে নিলেও উল্লেখযোগ্য একটি অংশ রয়েছে, যাদেরকে বাধ্য করা হয় এ জগতে প্রবেশ করতে। অনেকে কিভাবে মানবপাচারকারী খপ্পরে পড়ে পর্নোগ্রাফিতে অভিনয় করতে বাধ্য হচ্ছে সেসব বিষয়ও তুলে ধরা হচ্ছে। এমনকি শিশুদের দিয়ে কিভাবে জোর করে পনোগ্রাফি তৈরি করা হচ্ছে তারও অনেক লোমহর্ষক বিবরণ উঠে আসছে নানা গণমাধ্যমে।

সম্প্রতি পর্নোগ্রাফির অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে এসে একজন অভিনেত্রী একটি বই লিখে প্রকাশ করেছেন কিভাবে চক্রের শিকার হয়ে তিনি পর্ণো ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছেন এবং তার ওপর কিভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। এরপর তিনি বইতে দর্শকদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখেছেন এরপরও কি আপনারা পর্নো দেখতে আগ্রহী হবেন?

নৈতিকতার দিক ছাড়াও শরীর এবং মনোবৃত্তি কোনো দিক দিয়েই যে এটা কল্যাণকর নয় সেসব বিষয়ও তুলে ধরার চেষ্টা করছেন অনেকে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার মাধ্যমে। বিভিন্ন সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পর্নো আসক্তরা একধরনের ফ্যান্টাসিতে ভোগে এবং বাস্তব জীবনেও তারা পর্নো নায়িকার মতো সঙ্গিনী চায়। আর তা না পাওয়ায় তাদের অনেকেই বাস্তব জীবনে সুখী হতে পারে না। কোনো কোনো সমীক্ষায় বলা হয়েছে অধিক পর্নো আসক্তদের অনেকেরই অনুভূতি ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে যায় এবং বাস্তব জীবনে সঙ্গিনীর প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকে। কারণ তাদের মন-মগজে স্থান করে নেয় পর্নো চরিত্রগুলো। কেবল সেগুলোতেই তারা উদ্দীপিত হয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে এসব সমীক্ষায়। এর ফলে তাদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। এভাবেই পর্নো আসক্তি থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা।

আপনার মতামত দিন