নিউজ৩৯,বিশেষ প্রতিবেদনঃ দোহারের আলোচিত শাকিল হত্যাকান্ড, একটি হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক মৃত্যু উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ।প্রবাসী স্ত্রীদের পরকীয়ায় জড়িয়ে যাওয়ার যে সামাজিক ব্যাধি দোহার নবাবগঞ্জে শুরু হয়েছে, যেভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান্সহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মদ, বিদেশি বোতল ও ইয়াবার বিস্তার মহামারী আকার ধারণ করেছে তা থেকে কি শিখবে কিছু দোহার-নবাবগঞ্জবাসী। না’কি স্বাভাবিক ঘটনার মতোই ভুলে যাবে সবকিছু।নিউজ৩৯ এর অনুসন্ধানে তুলিয়ে ধরা হয়েছে কিভাবে একজন স্ত্রী’র জীবনে ৩ পুরুষ এলো, কিভাবেই বা একজন স্বামীর অনুরক্ত স্ত্রী বিরক্ত হয়ে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।
শাকিল হত্যাকান্ডে তার বাবা বাদীর নারাজির পর মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব পায়। পুলিশের নতুন এই তদন্ত বিভাগ ছয় মাস তদন্ত শেষে জানতে পারে এটি হত্যাকাণ্ড। তারা দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।পিবিআই’র অভিযানে মো. ইব্রাহিম ও আলেয়া আক্তার আলোকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইতিমধ্যে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে আলো। গ্রেফতার ইব্রাহীম যুবলীগ নেতা মিল্কী হত্যার সাত নম্বর নামীয় আসামি। তার বিরুদ্ধে আরও একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজী ও হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পিবিআই।
আলোর জীবনে এসেছে তিন পুরুষ। তারমধ্যে একজনকে জীবন দিতে হয়েছে। নিহত মির্জা শাকিলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কৈশোর থেকেই। ঢাকার দোহারের দক্ষিণ জয়পাড়ার মির্জা পরিবারের ছেলে শাকিল। একই গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আলো। একই এলাকায় বসবাসের সুবাদে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে তাদের। এরমধ্যেই আলেয়ার বিয়ে হয় সিঙ্গাপুর প্রবাসী কোরবান খানের সঙ্গে। কিন্তু প্রেমের পথে এই বিয়ে কোনো বাধা হতে পারেনি। কোরবান খান দেশের বাইরে যাওয়ার পর শাকিল ও আলোর সম্পর্ক আরো গভীর হয়। ঢাকার বিভিন্নস্থানে চুটিয়ে প্রেম করতো তারা। স্বামী বিদেশে থাকায় এতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। এরমধ্যে দুটি সন্তানের জন্ম হয় আলোর গর্ভে। সন্তান, সংসার কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি শাকিলের প্রেম থেকে। যদিও পাড়া-প্রতিবেশীদের সমালোচনার শিকার হচ্ছিলো এই প্রেমিকজুটি। ২০১৫ সালের শেষের দিকে এক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে দোহার থেকে প্রেমিকের হাত ধরে ঢাকায় আসে আলো। মির্জা শাকিলের সঙ্গে ঘর বাঁধে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ইতিমধ্যে আগের স্বামীকে ডিভোর্স দেয়। কিন্তু ডিভোর্স লেটার তাকে পাঠানো হয়নি।
যাত্রাবাড়ীতে শাকিলের ভাড়া বাসাতে সাবলেট হিসেবে উঠে তার বন্ধু ইব্রাহিম। মাদারীপুরের শিবচরের মাতবরের চর গ্রামের ইব্রাহিম থাকতো ঢাকার বড় মগবাজারের চেয়ারম্যান গলিতে। মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িত ইব্রাহিম। সাবলেট থাকার সুবাধে অল্পদিনেই শাকিলের প্রেমিকা কথিত স্ত্রী আলোর দিকে নজর পড়ে ইব্রাহিমের। সাড়া দেয় আলোও। শাকিলের অলক্ষ্যে জন্ম হয় আরেকটি পরকীয়া প্রেমের। আদালতে দেয়া আলোর স্বীকারোক্তি অনুসারে, রাত-বিরাতে তাদের বাসায় হতো মদের আড্ডা। মদ পান করতো ইব্রাহিম, শাকিল ও আলো। মদ পান করিয়েই ‘হত্যা’ করা হয় শাকিলকে। ২০১৬ সালের ২৫শে জানুয়ারি রাতে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ওই বাসায় শুরু হয় মদের আড্ডা। এতে শাকিল, ইব্রাহিম, আলো ছাড়াও অংশ নেয় ইব্রাহিমের বন্ধু রবিন ও নাহিদ। রাত ২টার দিকে রবিন, নাহিদ চলে যায়। এদিকে, আড্ডা শেষ হতে না হতেই অসুস্থ হয়ে যায় শাকিল। একের পর এক বমি করতে থাকে। মুখ দিয়ে লালা বের হয়।
আলো জানিয়েছে, ২৭শে জানুয়ারি শাকিলকে একটি ওষুধ সেবন করায় ইব্রাহিম। তারপর শাকিলের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। এসময় বাইরে থেকে কেচি গেইট বন্ধ করে পালিয়ে যায় ইব্রাহিম। আলো জানিয়েছে, শাকিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গেলে চিৎকার করে কান্না করছিলো সে। এসময় আশেপাশের লোকজন বাসার কেচি গেইটের তালা ভেঙে দিলে শাকিলকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যায় আলো।
অবশ্য পিবিআই’র তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক হুমায়ূন ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শাকিলের মৃত্যু হয়েছে। শাকিলের লাশ ঢামেকে রেখে ইব্রাহিমের সঙ্গে পালিয়ে যায় আলো। শাকিলকে ‘হত্যা’র পর ঢাকাতেই স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করতো আলো ও ইব্রাহিম। মগবাজারের বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থেকেছে প্রায় ছয় মাস। তারপর ইব্রাহিমের সঙ্গে সম্পর্ক টিকেনি। এই সম্পর্কের ইতি টেনে প্রথম স্বামী প্রবাসী কোরবানের কাছে ফিরে যায় আলো ওরফে আলেয়া।
শাকিলের পিতা নুরুল ইসলাম জানান, শাকিলের লাশ ঢামেক হাসপাতালে রেখে যাওয়ার পরপরই অজ্ঞাত একজন ফোনে জানায় তার ছেলের লাশ ঢামেকে। খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান সেখানে। নিহত শাকিলের মুখ দিয়ে তখনও লালা ঝরছিলো। নুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে মদের সঙ্গে বিষাক্ত বা ওষুধ জাতীয় কিছু সেবন করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে হত্যার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৮ই মার্চ যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নুরুল ইসলাম। ওই মামলায় থানা পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে পুনরায় তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। গত ২৮শে এপ্রিল সকালে দোহারের দক্ষিণ জয়পাড়ার কোরবান খানের বাড়ি থেকে আলেয়া ওরফে আলোকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তার দেয়া তথ্যানুসারেই পরদিন ধোলাইপাড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ইব্রাহিমকে।
নিহত শাকিলের বড় ভাই মির্জা মহসিন নিউজ৩৯কে বলেন, ‘শাকিল যে যাত্রাবাড়ীর বাসায় ভাড়া ছিল, সেটি আমাদের পরিবারের কেউ জানতো না। আমরা জানতাম তার এক বন্ধুর সঙ্গে সে থাকতো। বাড়ি থেকে টাকা নিতো। ফোনে কথা হতো তার সঙ্গে। দোহায় বেশি একটা যেত না।’
তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি দুপুরের দিকে আমার বোন জামাইকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে জানানো হয় শাকিল মারা গেছে। তখন পরিবারের সবাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন। এরপর আমার বাবা যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের সঙ্গে ওই বাসাটিতে যান। সেখানে তখন কেউ ছিল না। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফন করা হয়।’
শাকিলের বাবার দায়ের করা হত্যা মামলাটি তদন্ত করেন যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন কারকুন। তবে কোনও আসামিকে তিনি গ্রেফতার করেনি। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শাকিলের মৃত্যুর কোনও কারণ লেখা হয়নি। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা নয়ন কুরকান আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে ২০১৭ সালের ৩১ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দাখিল করেন। যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মামলাটি এক বছর দুই মাস তদন্ত করে। তাদের ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে মামলার বাদি আদালতে নারাজি দেন। আদালত ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর মামলাটি পিবিআই’কে তদন্তের নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশের পর পিবিআই ঢাকা মেট্রোর উপপরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন কবির মোল্লা মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি পাঁচ মাস ধরে মামলাটি তদন্ত করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পান।
পিবিআই ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। শাকিলকে পরিকল্পনা করেই হত্যা করা হয়। এতে সহযোগিতা করে আলেয়া। হাসপাতালে শাকিলকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণার পরই ইব্রাহীমের সঙ্গে আলেয়া পালিয়ে যায়। তারাই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে আবার শাকিলের পরিবারকে মৃত্যুর খবর জানায়।’
ঘটনার পর কিছুদিন আলেয়া পালিয়ে থাকলেও পুনরায় সে তার আগের স্বামীর সঙ্গে গিয়ে থাকা শুরু করে। গত ২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তাকে দোহারের দক্ষিণ জয়পাড়া থেকে গ্রেফতার করে পিবিআই। আদালতে সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধি দেয়। পরদিন ২৯ এপ্রিল পিবিআই সদস্যরা ইব্রাহীমকে যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড় এলাকা থেকে গ্রেফতার করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হুমায়ুন কবির মোল্লা বলেন, ‘আমরা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দুইজনকে গ্রেফতার করেছি। এদের মধ্যে আলেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধি দিয়েছে। ইব্রাহীম দুই দিনের রিমান্ডে আছে। এছাড়াও নাহিদ নামে অপর একজন সাক্ষী দিয়েছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আসামির স্বীকারোক্তিতে তাই মিলছে এখন পযন্ত।’
এ রকম হত্যাকাণ্ড যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের তদন্তে কেন আসলো না? জানতে চাইলে মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ও যাত্রাবাড়ী থানার এসআই নয়ন কারকুন বলেন, ‘আমি ময়নাতদন্তের ওপর ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছি। হত্যার বিষয়ে কিছু পাইনি। এখন যদি তদন্তে কিছু পায় তাহলে তো ভালো। পিবিআই আমাদের একটি ইউনিট।’
যাত্রাবাড়ী থানার এই তদন্ত কর্মকর্তা ফাইনাল রিপোর্টে লিখেছেন, মৃত্যুর কোনও সঠিক কারণ জানা যায়নি। বাদি ভুল বুঝে মামলাটি করেছে। এটি তথ্যগত ভুল। আসলে তার মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক।
নিহত শাকিলের পরিবারের প্রশ্ন, যদি শাকিল মদ খেয়ে মারা যায়, তাহলেও তা ময়নাতদন্তে আসা উচিৎ ছিল। কিন্তু কোনও কারণই আসেনি। তাদের কাছে বিষয়টি সন্দেহজনক হিসেবে প্রতীয়মান হয়। কারণ যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তে উল্লেখযোগ্য কিছুই করেনি।