তুরস্ক ভ্রমণ | ২৮শে মে, ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, দার্দানেলিসের হাসপাতালে চা খেয়ে প্রাচীন ট্রয় নগরী এবং আজিসার ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য আমরা প্রস্তুত হলাম। বেলা প্রায় ৮টার সময় কয়েকটি অশ্বশকট এবং কয়েকটি উৎকৃষ্ট অশ্বে আমরা ১০/১২ জন ভারতবাসী এবং ৪/৫ জন তুর্কী-সোওয়ার এবং দার্দানেলিস নিবাসী তুর্কী হেলালে-আহমর বা রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের ম্যানেজার কালাম বে আমাদের তত্ত্বাবধানের জন্য সঙ্গে গমন করেন। দার্দানেলিস শহর অতিক্রম করে একটি সুপ্রশস্ত রাজবর্থ অবলম্বন করে আমরা চলতে লাগলাম। রাস্তাটির দুই পাশে নানা জাতীয় বিচিত্র পুষ্পরাশি-প্রস্ফুটিত হয়ে অপূর্ব শোভা বিস্তার করছিল। বসন্তের উজ্জ্বল প্রভাতে এবং মৃদুমন্দ সমীরণ সঞ্চারে বেশ প্রফুল্লতা বোধ করতে লাগলাম। নিদারুণ শীত ঋতুর অবসাদ ও জড়তার সূর্য করোজ্জ্বল নব প্রভাতের দৃশ্য মর্মের স্তরে স্তরে এক নব আনন্দ ও নব স্ফূর্তির সঞ্চার করছিল। হায়দ্রাবাদ নিবাসী মৌলভী আবদুল কাইয়ুম সাহেব আমার গাড়ীতেই ছিলেন। তিনি আমাকে কয়েকটি বাঙ্গালা গান করতে বলায় আমি “বিশ্বধন্যা জগত্মান্যা মা আমার সোনার বাঙ্গালা” এবং ‘দেশ ভকতের ভস্মের ভিতে” প্রভৃতি জাতীয় সঙ্গীত গাইতে লাগলাম। ক্রমে আমাদের অশ্বযান দার্দানেলিস সমুদ্রের তীরের রাস্তা দিয়া অক্র বক্র গতিতে দ্রুত চলতে লাগল। শকট হইতে দার্দানেলিসের নিস্তরঙ্গ শান্ত জলরাশির নীলিমার শোভায় চক্ষু তৃপ্ত হইতে লাগল। শান্ত বালিকার সাঁঝের আকাশের প্রথম তারকা দর্শন কালের অপলক আঁখির কৃষ্ণতারা যেমন স্থিরতার মধ্যে মধুরতা ফুটিয়ে তোলে; দার্দানেলিস প্রণালীর জলরাশিও যেন তেমনি দুই পার্শ্বস্থ শ্যামজ বন বাজের মনোহারিণী শোভা সন্দর্শন মানসে মুগ্ধ আঁখিতে তাকিয়ে আছে। দুই উন্নত ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী দার্দানেলিসের শোভা সত্যই এমনি কবিচিত্ত বিমোহিনী।
বেলা ১২টার সময় সমুদ্র তীরবর্তী এক ক্রমোচ্চ ভূভাগে উপস্থিত হই। এখানে একদিকে অসংখ্য চীর বৃক্ষের শ্যাম-শোভা এবং তাহার নিম্নে সমুদ্রের শোভায় কবিত্বের ভাবে হৃদয় উচ্ছ্বাসিত হতে লাগল। মনে হতে লাগল জনৈক কবি সহচর সহ এখানে বাস করতে পারলে জীবন সার্থক হত। চীর বৃক্ষের শীতল ছায়ায় কম্বল পেতে সহচরদের সাথে ডিম, পনির এবং রুটি খেয়ে জঠর জ্বালা নিবারণ করলাম। ২৫ মিনিট কাল বিশ্রাম করে পরে আবার আমরা গন্তব্য পথে অগ্রসর হই। গাড়ি ক্রমে সমুদ্র তট হইতে কিছুদূর দিয়া চলতে লাগল। রাস্তাটি অতি সুন্দর, পরিষ্কৃত এবং সমতল। উচ্চ নীচু ভূমি এবং ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পাহাড়ের উপর দিয়ে সৰ্প গতিতে এই রাস্তা দার্দানেলিস হতে শামদেশ পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
রাস্তার দুই পাশে কত জাতীয় অগণিত বন্য ফুল ফুটেছে; তা লিখবার নয়, কেবল দেখার জিনিস। ক্রমে আমরা আরও কিছু অগ্রসর হলে, উদ্যানবৎ সুশোভন বিশাল ভূমিখণ্ডের মধ্যবর্তী পথ দিয়ে গাড়ি যেতে লাগল। যতদূর দৃষ্টি চলে ততদূর পর্যন্ত চীর, আঞ্জীর ও জয়তুনের অগণন সুবিন্যস্ত বৃক্ষশ্রেণী দেখতে পেলাম। উচ্চ নীচু ভূমির উপরে শ্যাম তরুশ্রেণীর একটানা শোভা বড়ই মনোরম বলে বোধ হচ্ছিল। শস্যশ্যামল পুষ্পিত ভূমি, তৃণগুল্মসমাচ্ছন্ন উন্নত পর্বত, কলনাদিনী বক্র গতি স্রোতস্বতী এবং সুপরিকৃত পরিপাটি রাস্তার দৃশ্যে আঁখি জুড়িয়ে যেতে লাগল। “চাহে মন্দারস্” নামক পার্বত্য ক্ষুদ্র নদীর বাঁকে এক এক জায়গায় সমতল ভূমিতে সবুজ গোধূম শস্যের শোভা এবং নানা জাতীয় বন্য ফুলের সম্মিলিত সৌন্দর্যে চক্ষু মুগ্ধ হয়ে যেতে লাগল। সত্যই জীবনে এমন মনোহর প্রদেশ আর দেখি নি। আনন্দ আবেশে সকলই ‘কুদরতী বাগ” অর্থাৎ শাম বা সিরিয়া দেশের প্রাকৃতিক উদ্যান বলে মনে হল। “চাহে মন্দারস্” নদীর স্রোতে অসংখ্য রেলওয়ে স্লিপার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, দেখতে পেলাম। উদ্যানের কোনও বন হইতে কাষ্ঠ কাটিয়া এই সমস্ত স্লিপার প্রস্তুত করতঃ নদীর স্রোতে ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ভাটিতে নির্দিষ্ট স্থানে স্লিপারগুলি ধরিয়া তুলিয়া লওয়া হইতেছে। এইরূপ মনোহর দৃশ্যপূর্ণ দেশের ভিতর দিয়া অন্যূন ১০ মাইল অগ্রসর হইয়া একটি বৃহৎ গ্রামে উপস্থিত হইলাম। গ্রামে খৃস্টানের সংখ্যাই খুব বেশী। লোকসংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। গ্রামে কয়েকটি স্কুল এবং মিউনিসিপালিটি আছে। গ্রামটি সমুদ্রের নিকটবর্তী বলিয়া গ্রীকদিগের আক্রমণ ভয়ে সমুদ্রের তীরে একটি সামরিক আড্ডা বসিয়াছে। কর্নেল মোহাম্মদ আলি ৭ শত সৈন্য লইয়া সর্বদা সমুদ্রতীর পর্যবেক্ষণ করিতেছেন। সমগ্র দার্দোনেলিস এবং ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তী বহু শত মাইল উপকূল সীমান্তে গ্রীক এবং ইটালীর রণতরির আক্রমণ ভয়ে তুর্কীকে অন্ততঃ তিন লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করিতে হইয়াছিল। এই সমস্ত বিপদের জন্যই তুর্কী গভর্নমেন্ট ভীষণ বলকান সমরে শত্রুদের সম্মিলিত দশ লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র তিন লক্ষ সৈন্য সমাবেশ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। নৌশক্তির অভাবই তুরস্কের সমূহ বিপদ এবং সর্বনাশের কারণ। যে সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত-উপকূলের পরিমাণ ১৮ শত মাইলেরও উপর এবং ভূমধ্য সাগরের বহু দ্বীপাবলী যাহার করতলগত সে সাম্রাজ্যের পক্ষে পাঁচ খানি রণতরি এবং ৮ খানি মাত্র ক্রুজার লইয়া নৌশক্তির গর্ব, কত সামান্য এবং উপহাসজনক! সুলতান আবদুল হামিদ খানের ৩০ বৎসর রাজত্বের প্রতি বৎসর এক একখানি করিয়া রণতরি নির্মিত হইলেও তুর্কীর নৌশক্তি বহু প্রবল হইত। কিন্তু সুলতান আবদুল হামিদ এ দীর্ঘকাল কেবল বিলাস-ব্যাসন এবং স্বেচ্ছাচারী অন্ধ রাজ শক্তির উন্নতিকামী সার্বভৌম প্রভুত্বের বিরোধী নব্য তুর্কী দলের মস্তক চর্বন অভিলাষেই সমস্ত শক্তি ব্যয় করিয়াছিলেন।
আমরা এখানে কর্নেল মোহাম্মদ আলী বে’র আতিথ্য গ্রহণ করিয়া তৃপ্তি লাভ করি। তিনি আমাদিগকে যথেষ্ট সম্বর্ধনা এবং সমাদর করেন। অতঃপর এই গ্রাম ত্যাগ করিয়া আমরা দ্রুত অগ্রসর হইতে থাকি। পথের দুই পার্শ্বে “গোলেলালা” নামক এক জাতীয় অত্যুজ্জল রক্তবর্ণ ফুলের বহু সন্নিবেশ দেখিয়া মুগ্ধ হই। কয়েক মাইল যাইয়া “টানারলীক” নামক এক ময়দানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সেখানে বহু শত সৈন্যের তাম্বু পড়িয়াছে। কর্নেল আমাদিগের আগমন দর্শন করিয়াই শশব্যস্তে পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। কর্নেলের সৈন্যবৃন্দ সারি বাঁধিয়া আমাদিগকে সামরিক কায়দায় সালাম জানাইলেন। আমরা কিয়ৎক্ষণ তথায় বিশ্রাম করিবার পর আবার অশ্ব ও শকটারোহণে গন্তব্য পথে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। বিদায়ের সময় কর্নেল এবং তাহার সহকারীগণ প্রাণের আবেগপূর্ণ ভাষায় আমাদিগকে ধন্যবাদ এবং প্রীতি জ্ঞাপন করিতে লাগিলেন। তুর্কীদিগের সৌজন্য এবং ভদ্রতা বাস্তবিকই অতুলনীয়। পথের মধ্যে মধ্যে অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড় অতিক্রম করা গেল। পাহাড়ের গাত্রে বেষ্টন করিয়া স্তরে স্তরে পাথর কাটিয়া চক্রাকারে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া পাহাড়ের উপর দিয়া অতি সুন্দর রাস্তা প্রস্তুত করা হইয়াছে। স্থানে স্থানে পাহাড়ের গায়ে রাস্তার পার্শ্বে নানা জাতীয় পার্বত্য-জাত বিচিত্র কুসুম আত্মবিকাশ করিয়া বায়ু ভরে দোল খাইতেছিল। কয়েক স্থানে জয়তুন বৃক্ষের বাগানে বাঙ্গালার চিরপরিচিত ঘুঘু দেখিয়া আনন্দিত হইলাম।
‘চাম্ওবা’ হাসপাতাল
এইরূপ নানা দৃশ্য দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমাদের গন্তব্যস্থান “চাম্ওবা” নামক হাসপাতালের নিকটবর্তী হইলাম। এই অস্থায়ী হাসপাতালটি এক স্বাস্থ্যকর উন্নত পৰ্ব্বত শৃঙ্গে অবস্থিত। পাহাড়ের পাদমূলে আমরা শকট হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজে পাহাড়ের উপরে উঠিতে লাগিলাম। এখানে বায়ু শুষ্ক এবং লঘু বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত পাথরের গায়ে যথেষ্ট লৌহ আছে, দেখিতে পাইলাম। আমরা পাহাড়ের উপরে উঠা মাত্রই বহু ভাষাবিদ প্রসিদ্ধ ডাক্তার হাসান বে পরম সমাদরে আমাদিগকে অভ্যর্থনা করেন৷ এই চাম্ওবা পর্ব্বতের হাসপাতালে বহুসংখ্যক সম্ভ্রান্ত তুর্কী কর্মচারী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন। একজন পাশা এবং একজন সেনাপতির সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হইল। বৃদ্ধ পাশা আমাদিগকে দেখিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন। এই সুরম্য পার্ব্বত্য প্রদেশে “হিন্দী কারদাস্” অর্থাৎ হিন্দুস্থানের ভ্রাতাদিগকে দেখিয়া পাশার চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল। এই দারুণ দুর্দিনে মনে হইতে লাগিল যেন কত যুগ-যুগান্তের আজ আমরা “ভাইহারা” ভাই সকলে একত্র সম্মিলিত হইতেছি। সেই মুক্ত সান্ধ্য গগনের নীচে উন্নত পর্ব্বত শৃঙ্গোপরি চীরবৃক্ষ তলে লম্বা লম্বা টেবিল এবং চেয়ার পাতিয়া ভোজের বন্দোবস্ত করা হইল। এক একজন তুর্কী এবং এক একজন হিন্দুস্থানী পাশাপাশি বসিয়া আহার করিতে লাগিলাম। ভোজে আমাদের উদর পূর্ণ হইতে আর ভ্রাতৃপ্রেমের পীযূষধারায় আমাদের হৃদয় প্লাবিত হইতে লাগিল। অস্ফুট চন্দ্রালোকে সেই পৰ্ব্বতশৃঙ্গে বসিয়া মনে হইতে লাগিল, যেন আজ জাতীয় জীবনের এই দারুণ দুর্দিনে যুগান্তের অন্ধতমস ভেদ করিয়া ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার তীব্র-বিদ্যুত-শিখা সমগ্র মোসলমান জগৎ হইতে তুরস্কভূমে ছুটিয়া আসিতেছে। সে বিদ্যুৎ-শিখা কি তীব্র জ্বালাময় এবং তেজোময়! ফলতঃ আত্মবিস্মৃত কর্মবিমুখ নিদ্রাতুর মোসলমানের মস্তকে ভীষণ বজ্রপাত করিয়া বিধাতা কি পরম দয়ার পরিচয়ই দিয়াছেন! এ বজ্রপাতে মরক্কো হইতে মালয় পর্যন্ত কোটি কোটি বিচ্ছিন্ন আত্মার মধ্যে এক মহা ঐক্যের উচ্ছ্বাস উত্তাল তরঙ্গ রঙ্গে প্রবাহিত হইতেছে। বিধাতার করুণা এবং কৌশলের কথা স্মরণ করিয়া হৃদয় শ্রদ্ধা ভরে তাঁহার নিখিল-শরণ মঙ্গল চরণে নত হইয়া পড়িল! আহারান্তে কিছুক্ষণ তুর্কীবন্ধুদিগের সহিত আলাপাদি করিয়া বস্ত্রাবাসে প্রবেশ পূর্বক ক্লান্ত শরীর শয্যায় ঢালিয়া দিলাম।
পর দিবস (২৯শে মে) ঊষার কণকচাঁপা কিরণকর স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই জাগরিত হইয়া পার্বত্য প্রকৃতির মুক্ত দৃশ্য দর্শন করিয়া পরমানন্দ লাভ করিলাম। এই মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজের হৃদয়কেও যেন মুক্ত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলাম। চতুর্দিকস্থ পর্বতের অরণ্য সমূহের শ্যাম রেখার শীর্ষে এবং কোনও কোনও উচ্চ শৃঙ্গস্থ বরফস্তূপের উপরে ঊষার আলোক পড়ায় বড়ই শোভা হইয়াছিল। এই নিরাবিল পার্বত্য নিকেতন আমার নিকট রাজপ্রাসাদ অপেক্ষাও কত উন্নত এবং শোভনীয় বলিয়া বোধ হইতেছিল। চীরবৃক্ষের ডাল কাটিয়া তুর্কীরা এক কৃত্রিম কুঞ্জ প্রস্তুত করিয়াছিলেন। আমাদের উপাসনার জায়গা সেই স্থানে নির্দিষ্ট হইয়াছিল। আমি সেই স্থানে কম্বল পাতিয়া উপাসনা এবং প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। মনে হইতে লাগিল, রাজপ্রাসাদবাসী রাজা অপেক্ষা পৰ্ব্বতবাসী ফকিরের সুখ ও আনন্দ কত বেশী!
উপাসনা শেষে পাহাড়ের নীচে ছাগ ও মেষপাল দেখিতে গেলাম। পাহাড়ের পাদমূলে নূতন সবুজ ঘাস ছিল, সেখানে চারণের জন্য কতকগুলি রাখাল বালক মেষ ও ছাগমূখ লইয়া আসিয়াছে। ছাগ ও মেষগুলি আমাদের দেশের ছাগ ও মেষ হইতে অনেক বৃহৎ এবং বলিষ্ঠ। এখানে ছাগলের দুগ্ধও বেশ প্রচুর পাওয়া যায়৷
দ্বিপ্রহরের আহারান্তে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করি। একটি চীরবৃক্ষের শাখায় একটি দোলনা বাঁধা ছিল। একটি আরব বালক সেই দোলনায় বসিয়া দোল খাইতেছিল। আমি এবং আমার কতিপয় সহগামী বন্ধুও পর্যায়ক্রমে সেই দোলনায় বসিয়া দোল খাইতেছিলাম। দোলনায় দোল খাইবার অভ্যাস থাকিলে, সামুদ্রিক পীড়া আক্রমণ করিতে পারে না। এজন্য তুর্কী-প্রবীণ ব্যক্তিগণও দোল খাইতে ভালবাসেন।
গ্রাম পরিদর্শন
অপরাহে আমরা প্রায় তিন মাইল দূরবর্তী “আক্কুই” নামক একটি প্রসিদ্ধ গ্রামে অশ্বারোহণে যাত্রা করি। আমি যে ঘোড়ায় আরোহণ করিয়াছিলাম সে ঘোড়া আমার পক্ষে অসুবিধাজনক বোধ হওয়ায় দুইবার আমাকে ঘোড়া পরিবর্তন করিতে হয়। একেত আমি অশ্বারোহণে তখনও সম্পূর্ণ পটুতা লাভ করিতে পারি নাই, তাহার উপর অনবরত পাহাড়ের চড়াই এবং উত্রাই দ্রুতবেগে অতিক্রম করিয়া ছুটিতে হইতেছিল; সুতরাং আমি একটু হয়রান হইয়া পড়িলাম। এক স্থানে উপত্যকার সমতল ভূমিতে অতি সুন্দর গমের ক্ষেত্র দেখিতে পাইলাম। গমের গাছগুলি আমাদের দেশের গাছ অপেক্ষা অনেক বৃহৎ । আমাদের সমুচ্চ তুর্কী অশ্বগুলি ক্ষেত্রের ভিতর দিয়া যাইবার সময় প্রায় ডুবিয়া যাইতেছিল। সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমরা গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। গ্রামের বালকেরা আমাদিগকে দেখিয়া পরমানন্দে দৌড়াইয়া আসিয়া ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া আমাদিগকে অশ্ব হইতে অবতরণ করিতে সাহায্য করিল। বালকদিগের অযাচিত সাহায্য এবং সৌজন্যে আমরা মুগ্ধ হইয়া গেলাম। কয়েকজন বালক আমাদিগের জন্য তৎক্ষণাৎ শীতল জল এবং কফি লইয়া আসিল। আমাদের আগমনে তাহারা যে অত্যন্ত সুখী এবং আনন্দিত হইয়াছে, তাহা তাহাদের চোখ মুখের ভাবভঙ্গী হইতে খুবই প্রকাশ পাইতেছিল। গ্রামের মক্তব বা পাঠশালার মৌলভী এবং প্রধান ধর্মাচার্য ইমাম ত্রস্তপদে আসিয়া আমাদিগকে সমাদরে সম্বর্ধনা করিতে লাগিলেন। পক্ক শুশ্রুধারী বৃদ্ধ ইমাম সাহেব, আমরা সুদূর হিন্দুস্থান হইতে যে এই জাতীয় ভীষণ দুর্দিনে বল্কানের রণক্ষেত্রে আগমন করিয়াছি তজ্জন্য পুনঃপুনঃ ব্যাকুলান্তরে আমাদিগকে ধন্যবাদ করিতে লাগিলেন। আমিও গ্রামের সমস্ত তত্ত্ব সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। গ্রামে ১২০ ঘর লোকের বাস। এই গ্রাম হইতে ৭০ জন যুবক যুদ্ধে গমন করিয়াছেন। এই জন্য আমরা গ্রামে প্রায় কোনও যুবককে দেখিতে পাইলাম না। গ্রামের সমস্ত লোকই কৃষিজীবী। গ্রামের এক পার্শ্বে মধ্যস্থলে সর্বসাধারণের জন্য বৈঠকখানা । আমাদের দেশে সন্ধ্যার পরে আমরা নিজ নিজ বাড়িতে নিজের আত্মীয়স্বজন কিম্বা দুইচারজন অনুগত ব্যক্তি লইয়া নিজের ব্যক্তিত্ব ও মহিমা এবং অপর সকলের কুৎসা কীর্তন করিতে থাকি; এখানকার নিয়ম সেরূপ নয়। এখানে সন্ধ্যার পরে গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই একত্র হয়। কাজেই ব্যক্তিগত কুৎসা বা কোনও প্রকারের নীচ স্বার্থমূলক আলোচনা করিবার সুবিধা হয় না। সুতরাং গ্রামে দল পাকাইয়া দলাদলি করিবার সম্ভাবনা নিতান্ত বিরল।
গ্রামের বিচার ব্যবস্থা
তুরস্কের প্রত্যেক গ্রামেই এক একজন গ্রাম্য কাজী নিযুক্ত আছেন। গ্রামের সর্বপ্রকারের মামলা, মোকদমা নিষ্পত্তি তিনিই সম্পন্ন করেন। নালিশ করিতে এখানের শহরেও কোনও পয়সা খরচ হয় না। আদালতের কোর্ট ফি দিবার নিয়ম এখনও এখানে অজ্ঞাত। গ্রামের বিচার গ্রামে হয় বলিয়া তুরস্কে অন্যান্য দেশের ন্যায় বিচার বিভ্রাট খুব কমই ঘটিয়া থাকে। গ্রামের জনমণ্ডলী কর্তৃকই কাজী সাহেব নিযুক্ত হইয়া থাকেন। বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ এবং সর্বাপেক্ষা চরিত্রবান ব্যক্তিকেই কাজীর পদে নিযুক্ত করা হয়। গ্রাম্য বিচারে কোনও উকিল-মোক্তারের আবশ্যক নাই। গ্রামস্থ সাক্ষী প্রমাণ লইয়াই বিচারকার্যের নিষ্পত্তি হয়। এই গ্রামে বালক বালিকাদিগের শিক্ষার জন্য দুইটি নিম্ন বিদ্যালয় আছে।
গ্রাম্য পোষাক-পরিচ্ছদ
এশিয়া বা তুরস্কের পরিচ্ছদ ইউরোপ হইতে অনেকটা পৃথক। কৃষকদিগের পরিধানে কতকটা কাবুলী ধরনের পায়জামা এবং মেরজাই ধরনের কোট দেখিতে পাইলাম। কোট এবং পায়জামা উভয়ই নীলবর্ণে রঞ্জিত। পা এবং পায়ের তলা অনেকেরই খোলা দেখিলাম। প্রত্যেক তুর্কী গ্রামের মধ্যস্থলে উপাসনার জন্য একটি করিয়া মসজিদ আছে। গ্রাম যতই বৃহৎ হউক না কেন, একটির অধিক মসজিদ কখনই প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। এদেশে প্রত্যেক মসজিদেই অন্ততঃপক্ষে একটি করিয়া সমুচ্চ মিনার থাকে। মিনারশূন্য মসজিদ কখনও হয় না। মহামান্য সুলতানের আদেশ ব্যতীত কোনও জামে মসজিদ কি শহরে কি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। আমাদের দেশে যেমন স্বার্থান্ধ মোল্লা সাহেবদের অনেকেই এক জুআর ঘর ভাঙ্গিয়া দুই তিন চারিখানির পত্তন পূর্বক ভীষণ দলাদলি এবং হিংসা বিদ্বেষের সৃষ্টি করিতেছেন, তুরস্কে তাহা একেবারেই অজ্ঞাত।
সন্ধ্যা সমাগত দেখিয়া “চাম্ওবা” গিরিশৃঙ্গস্থ বস্ত্রাবাসে ফিরিয়া যাইবার জন্য উদ্যত হইলে বৃদ্ধ ইমাম সাহেব এবং বালকের দল আমাদিগকে অন্তত রাত্রির জন্য সেই গ্রামে অবস্থান করিতে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। কিন্তু আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং বহু বিনয় ও মিনতি প্রকাশ পূর্বক আতিথ্য স্বীকারের দায় এড়াইয়া নির্দিষ্ট বাসস্থানাভিমুখে অশ্ব ধাবিত করিলাম। রাত্রি ৯.৩০টার সময় আমরা “চাওবা”য় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
আজিনা গ্রাম পরিদর্শন
অদ্য ৩০শে মে, ১৬ই জ্যৈষ্ঠ সকালে চা পান করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলাম। আজিনা নামক বিখ্যাত গ্রামের দিকে অশ্ব ছুটাইলাম । আজিনা, চাওবা হাসপাতাল হইতে অন্যূন ১৫ মাইল দূরবর্তী হইবে। প্রসিদ্ধ ডাক্তার হাসান বে এবং কালাম বে অদ্য আমাদের পথপ্রদর্শক। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্বত এবং উপত্যকা অতিক্রম করিয়া আজিনায় উপস্থিত হইলাম। আমরা রাজস্ব-সংগ্রাহক বা তহশীলদারের আফিসে যাইয়া সোজা উপস্থিত হইলাম। তহশীলদার সাহেব আমাদিগকে দেখিয়া পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। আমাদিগকে যথাযোগ্য আসনে বসাইয়া তহশীলদার সাহেব তৎক্ষণাৎ টেলিফোন যোগে গ্রামের কাজী সাহেব এবং অন্যান্য খৃস্টান ও মোসলমান প্রধান ব্যক্তিদিগকে আমাদিগের আগমন সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন। ১৫ মিনিট কাল অতীত হইতে না হইতেই গ্রামের কাজী সাহেব এবং আরও ৫ জন গ্রীক ও মোসলমান সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ত্রস্ত পদে আসিয়া আমাদিগকে গভীর সম্বর্ধনা করিলেন। তাঁহাদের বিনয় ও সৌজন্যে আমরা নিতান্ত প্রীতি ও মুগ্ধ হইয়া গেলাম।
আজিনা গ্রামের লোকসংখ্যা ৩০০০ তিন সহস্র। ইহার মধ্যে ২০০০ মোসলমান এবং ১০০০ খৃস্টান। মোসলমান বালকদের জন্য তিনটি এবং বালিকাদিগের জন্য একটি স্কুল আছে। খৃস্টানদিগের একটি স্কুল আছে। গ্রামে মিউনিসিপ্যালিটি আছে। গ্রামের বাজারটি বেশ বৃহৎ এবং পরিষ্কৃত পরিচ্ছন্ন। কয়েকটি কফিখানা, মসজিদ এবং অনেকগুলি দোকান আছে। আমাদিগের সংবাদ শুনিয়া গ্রামের বহু ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হন এবং আমাদের আদর অভ্যর্থনা করেন। এখানে চা বিস্কুট খাইয়া বেলা প্রায় ১২টার সময় “বর্গাস” নামক প্রসিদ্ধ পল্লী দেখিবার জন্য এখান হইতে রওয়ানা হই। প্রায় ১.৩০ দেড় ঘণ্টা অশ্ব চালনার পরে আমরা “বর্গাস” গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হই। এখানের কাজী সাহেব এবং ইমাম সাহেব আমাদিগকে অভ্যর্থনা করেন। শীতল জল পান এবং কফি সেবন করিয়া আমরা এখান হইতে শীঘ্রই বিদায় গ্রহণ করি । এই গ্রাম হইতে বহির্গত হইয়া আমি এবং মৌলভী আব্দুর রহমান পেশোয়ারী খুব বেগে ঘোড়া হাঁকাই। ঘোড়া বেশ বেগে ছুটিতে থাকে। ছুটিতে ছুটিতে আমার অশ্ব সম্মুখের দলবদ্ধ সহকারীদিগের অশ্ব শ্রেণীতে বাধা পাইয়া সহসা লাফাইয়া উঠে এবং তাহার ফলে আমি সজোরে ভূতলে নিক্ষিপ্ত হই। পশ্চাৎ হইতে দুইটি ঘোড়া আমার উপর দিয়া বেগে চলিয়া যায়, কিন্তু খোদার মর্জী আমি কোনও আঘাত প্রাপ্ত হই নাই। আমার সাংঘাতিক পতনে আমার সতীর্থগণ আতঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তুর্কী এবং হিন্দুস্থানী সকলেই ছুটিয়া আসেন। কিন্তু আমি তৎক্ষণাৎ অক্ষত অবস্থায় ভূতল হইতে উত্থিত হইয়া লম্ফ প্রদান পূর্বক অশ্বে আরোহণ করায় সকলেই সাধুবাদ করিতে লাগিলেন। সকলেই আমাকে সেই তেজস্বী অশ্ব ত্যাগ করিয়া একটি ঠাণ্ডা ঘোড়ায় চড়িবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সহিত বলিলাম, “আমি যখন এই ঘোড়া হইতে ভূপাতিত হইয়াছি, তখন ইহাতেই চড়িব।”
অতঃপর আমরা “কোট্টা আলী” নামক গ্রামে উপস্থিত হই। এই খানের গ্রামের বহির্ভাগস্থ এক মাঠের মধ্যে উপস্থিত হইয়া এক প্রকাণ্ড ‘চানার’ বৃক্ষের ছায়ায় আমাদের বনভোজনের আয়োজন হয়। পাউরুটি, মাখন, পনির, মাংস ও এক প্রকার পায়াস দধি এবং প্রচুর ফলমূল দ্বারা গ্রামবাসীগণ আমাদিগকে পরিতৃপ্তরূপে ভোজন করান। বালকেরা গ্রাম হইতে অনেক কার্পেট এবং বালিশ আনিয়া আমাদিগের বিশ্রামের বন্দোবস্ত করিয়া দেয়। আমরা যেমন রৌদ্রে গলদঘর্ম তেমনি ক্ষুধায়ও নিতান্ত ক্লিষ্ট হইয়া পড়িয়াছিলাম। সুতরাং বৃক্ষতলে মুক্ত প্রান্তরে আহার ও বিশ্রাম করিয়া পরম সুখানুভব করিতে লাগিলাম । প্রসিদ্ধ ডাক্তার এবং আমার অকৃত্রিম বন্ধু হাসান বে পূর্বেই এই বনভোজনের আয়োজন করিয়াছিলেন। খাদ্যদ্রব্যের কতকাংশ চাওবা হাসপাতাল হইতে আনীত হইয়াছিল। সুদূর দেশের তুর্কী ও ভারতবাসীর এই প্রীতিকর বনভোজনের মধুর স্মৃতি চিরকাল হৃদয়ে জাগরুক থাকিবে!
অনন্তর আমরা পুনরায় অশ্বারোহণে বহু পর্বত এবং অরণ্যভূমি অতিক্রম করিয়া সমুদ্রের নিকটবর্তী “আলিচা” নামক গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হই। আলিচায় যাইবার সময় পর্বতের পার্শ্বস্থ এক অতি সূক্ষ্ম পথ অতি সন্তর্পণে আমাদিগকে অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। প্রতি মুহূর্তে এখানে অশ্বের পদস্খলনের আশঙ্কা হইতেছিল।
“আলিচা” একটি সুন্দর গ্রাম। গ্রামের নিম্ন দেশ দিয়া একটি ক্ষুদ্র নদী প্রবাহিত! এখানে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এই প্রস্রবণের জল কয়েকটি চৌবাচ্চায় ধরিয়া অতি সুন্দর কয়েকটি স্নানাগার প্রস্তুত করা হইয়াছে ৷ এই জলে স্নান করিলে নানাপ্রকার ব্যাধি বিশেষতঃ গেঁটে বাতের উপশম হয় বলিয়া বহু লোকে এখানে স্নান করিতে আসে। এই সমস্ত স্নান যাত্রীর সুবিধা এবং আরামের জন্য এখানে একটি রমণীয় বৃহৎ হোটেলও প্রতিষ্ঠিত আছে। কিন্তু গ্রামটি সমুদ্র তীরবর্তী বলিয়া গ্রীক এবং ইটালীদিগের রণতরির গোলাবর্ষণ ভয়ে গ্রামবাসীদিগকে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে। গ্রামটি এক্ষণে উপকূল রক্ষাকারী তুর্কী সৈন্যদিগের অধিকারের মধ্যে পড়িয়াছে। আমরা অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া স্নানাগার পরিদর্শনের জন্য গমন করিলাম। প্রস্রবণটি বেশ বৃহৎ। জল অত্যন্ত উষ্ণ। জলে গন্ধকের তীব্র গন্ধ অনুভূত হইল। স্নানাগারটি কাষ্ঠদ্বারা উত্তমরূপে নির্মিত এবং বহু কুঠুরীতে বিভক্ত। তুর্কী স্নানাগার বাস্তবিক পক্ষে এক বিলাসের উপকরণ। “আলিচা” গ্রাম হইতে সন্ধ্যার পূর্বেই আমরা অশ্বারোহণে দিগ্বিজয়ী সেকান্দর শাহের স্থাপিত দ্বিতীয় ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ দর্শন মানসে গমন করি। পথিমধ্যে জনৈক তুর্কী কর্নেল সমস্ত সৈন্যসহ আমাদিগকে অভ্যর্থনা করেন। সেখানে আমরা অশ্ব পৃষ্ঠেই জলপান করিয়া ট্রয়ের দিকে বেগে অশ্ব পরিচালনা করি। চানার, ছাম ও জয়তুন বৃক্ষের বনের ভিতর দিয়া বহুদূর পর্যন্ত অশ্ব পরিচালনা করিয়া আমরা ভূমধ্যের অংশ লিবাত (লিবান্ট) সাগরের তীরদেশে উপস্থিত হই। এক দিকে শ্যামায়মান বনরাজির এক টানা সবুজ দৃশ্য আর অন্য দিকে মহা বিস্তৃত সমুদ্রের শান্ত স্নিগ্ধ নীলিমার কি মনোহর সমাবেশ! এক সময় এশিয়ার শ্যামতীর রেখা হইতে যখন তুর্কীবীরগণ ইউরোপের দিকে দৃপাত করিতেন, তখন ইউরোপ বিজয়ের বাসনা স্বভাবতঃই যে তাহাদের মনে বলবর্তী হইয়া উঠিত, তাহা স্পষ্টই অনুভূত হইতে লাগিল।
অনন্তর আমরা এক প্রকার অতি সুগন্ধি তৃণপূর্ণ ভূমির মধ্য দিয়া অশ্ব চালনা করিলাম। এই তৃণগুলি মখমলের ন্যায় কোমল। কস্তুরী মৃগের ইহা অতি প্ৰিয় খাদ্য৷ ডাক্তার হাসান বে বলিলেন যে, এই ময়দানে “এই সুগন্ধি তৃণ ভক্ষণের জন্য দলে দলে হরিণ বিচরণ করিতে আসে।” অতঃপর আমরা আরও কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলে দ্বিতীয় ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ আমাদের গোচরীভূত হইল।
কয়েকটি মার্বেল পাথরের অখণ্ড স্তম্ভ দেখা গেল। অধিকাংশ স্তম্ভই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। ক্রমে আমরা রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের নিকটবর্তী হইলাম। রাজ প্রাসাদের সামান্য অংশই দণ্ডায়মান আছে। একটি বুরুজের কিয়দংশ এখনও বিদ্যমান আছে। বুরুজ অপেক্ষা তোরণ দ্বারই বেশী উচ্চ। আমি অশ্বসহ তোরণের আশ্রয় স্তম্ভের উপরে আরোহণ করিলাম। এখান হইতে বহুদূর পর্যন্ত সমুদ্র, বনরাজি এবং গিরিমালা দেখা যাইতে লাগিল । তোরণের উপরে অশ্ব পৃষ্ঠে বসিয়া ইউরোপ দর্শন করিতে করিতে আমার চক্ষু জ্বলিতে লাগিল। এখানে নানা চিন্তা ও চিন্তাপ্রসূত কল্পনা, অতীত যুগের ঐতিহাসিক স্মৃতি প্রাণে জাগিয়া উঠিতে লাগিল। বর্তমানে জাতীয় শোচনীয় দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিতে করিতে আমার আঁখি ছল ছল করিয়া উঠিল।
যতক্ষণ পর্যন্ত সূর্যের শেষ রশ্মি ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশিষ্ট প্রাসাদ স্তম্ভ এবং তোরণের শীর্ষে জ্বলিতে ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত সান্ধ্য কিরণরাগ রঞ্জিত নদীর সমুদ্রের শান্ত স্থির বারি রাশির চিত্ত বিনোদিনী শোভা এবং ইউরোপের তীররেখা নির্নিমেষ লোচনে দর্শন করিলাম। সম্মুখেই বিশ্বলোচন সূর্য ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে অস্তমিত হইয়া পড়িল। সমুদ্রে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উভয় দৃশ্যই নিতান্ত কবিত্ব ব্যঞ্জক। সূর্যাস্তের পরম রমণীয় শোভা দর্শনে সেই সুদূর নির্জন পর্বত ও সাগর সঙ্কুল প্রদেশে মনে যে কত পুণ্যভাবের উদয় হইল, তাহা অবর্ণনীয় ।
অতঃপর গোধূলির শেষ আলো বিলোপের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তোরণ হইতে অবতীর্ণ হইয়া “চাম্ওবা” হাসপাতালের দিকে দ্রুত বেগে অশ্ব ধাবিত করিলাম । শুক্লা দশমীর চন্দ্র ক্রমে আলোক বিকীর্ণ করিতে লাগিল। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বেগে অশ্ব ধাবিত করিলাম। সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকে আমাদের অশ্বগুলি যখন নির্জন প্রান্তর উপত্যকা এবং অরণ্য বক্ষে পদাঘাতে প্রতিধ্বনি তুলিয়া ধাবিত হইতেছিল, অশ্বের বেগে আমাদের পার্শ্বস্থ তরবারীর কোষ যখন রেকাবের সহিত আঘাত প্রাপ্ত হইয়া ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিতে ছিল; সারাদিনের পরিশ্রম এবং সূর্যাতপ ক্লিষ্ট ললাটে যখন স্নিগ্ধ নির্মল বায়ুর প্রবাহ শৈত্য ঢালিয়া প্ৰবাহিত হইতেছিল, তখন সেই অবসর শরীরেও বীরজনোচিত স্ফূর্তি ও উৎসাহ বোধ করিতেছিলাম। মসীজীবী অপেক্ষা অসিজীবীর জীবন যেমন কঠোর, সেই তুলনায় তাহা অধিকতর স্ফূর্ত ও মূর্তও বটে! যাহা হউক আমরা মধ্যে মধ্যে জয়ধ্বনি করিতে করিতে অন্যূন ৩০ মাইল পথ অতিক্রম করিয়া রাত্রি একটার সময় শিবিরে উপস্থিত হইলাম। অনন্তর বিশ্রামে শরীর শয্যায় ঢালিয়া আরাম বোধ করিলাম।
দার্দানেলিসে প্রত্যাবর্তন
১৩২০ সন ১৭ই জ্যৈষ্ঠ কিছু বেলা হইলেই শয্যাত্যাগ করিলাম। পূর্ব দিনের অতিরিক্ত শ্রান্তিতে শরীর যারপর নাই ক্লিষ্ট এবং বেদনাযুক্ত ছিল। এজন্য কেহই প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করিতে সমর্থ হয় নাই। যাহা হউক শয্যা ত্যাগ করিয়া তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্যাদি সমাধান পূর্বক চা খাইয়া সাজ-সরঞ্জাম ঠিক করিতে লাগিলাম। আমি আসিবার দিন দার্দানেলিস হইতে অশ্ব শকটে আসিয়াছিলাম বলিয়া বিশেষ কোনও কষ্ট ভোগ করিতে হয় নাই ।
এক্ষণে প্রত্যাবর্তনের সময় এই সুদীর্ঘ ৮০ মাইল পথ অশ্বপৃষ্ঠে যাইতে হইবে বলিয়া কিছু চিন্তিত হইয়া পড়িলাম । অশ্বযানের অপেক্ষা করিলে দুই দিবস বিলম্ব হইবে বলিয়া অগত্যা অশ্বপৃষ্ঠে যাইতেই সম্মত হইলাম। আরব ও তুর্কী অশ্বারোহীগণ এবং সে কালের ভারতীয় সম্রাটদিগের মধ্যে বাবর, আকবর প্রভৃতি অনেকেই অশ্বপৃষ্ঠে ৪০/৫০ মাইল ভ্রমণ করিতেন, এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া বঙ্গবাসী হইলেও আরব রক্তের অভিমানে এ কয়েক দিন ৫০/৬০ মাইল অনবরত অশ্বপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করিয়াছিলাম। এই অত্যধিক অশ্বারোহণের ফলে আজ শরীরে এতই বেদনা বোধ হইতেছিল যে, অশ্বে আরোহণ করাই নিতান্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল।
যাহা হউক, কষ্টেই ইষ্ট লাভ মনে করিয়া একটি কৃষ্ণবর্ণ উৎকৃষ্ট অশ্ব বাছিয়া লইলাম। অতঃপর তুর্কী বন্ধুগণের এবং “চাওবা” হাসপাতালের সম্ভ্রান্ত উচ্চপদস্থ রোগীদিগের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া আমরা অশ্বারোহণ করিলাম আমাদের সেই অশ্বারূঢ়ভাবে ফটো তুলিবার পরে “চাওবা” হইতে দলবদ্ধ ভাবে হোমারের ইলিয়াডে বর্ণিত বিখ্যাত ট্রোজান বীরদিগের লীলাভূমি ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখিবার জন্য দ্রুতবেগে অশ্ব ধাবিত করিলাম। সুপরিস্কৃত রাজপথ অবলম্বন করিয়া অনেক দূর অগ্রসর হইবার পরে আমরা “চাহে মন্দারস্” নদীর পাষাণ সঙ্কুল উচ্চনীচ তীরের বিপজ্জনক সঙ্কীর্ণপথ দিয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত গমন করিলাম। এক এক জায়গায় পাহাড়ের খাদের সঙ্কীর্ণ পাশ দিয়া অতি সন্তর্পণে যাইতে লাগিলাম । এমন বিপজ্জনক স্থান যে, ঘোড়ার সামান্য মাত্র পদস্খলন হইলেই এ জীবনের জন্য দেহস্খলন হইবার পূর্ণ সম্ভাবনা । রৌদ্রের তেজ খুব প্রখর বলিয়াই বোধ হইতে লাগিল । রৌদ্র হইতে বাঁচিবার জন্য আমার অকৃত্রিম বন্ধু ডাক্তার হাসান বে তাঁহার নিজের “শম্সিয়া” আমাকে উপহার দিয়াছিলেন। এই তুর্কী শম্সিয়া বড় সুন্দর জিনিস। ইহাতে রৌদ্রে হ্যাটের কার্য সাধিত হইয়া থাকে। আমাদের দেশে এই তুর্কী শসিয়ার প্রচলন হইলে, অশ্বারোহী, সাইকেল আরোহী এবং রৌদ্রে গমনাগমনের জন্য সকলের বিশেষ সুবিধা হইতে পারে। আমাদের এই ভীষণ গ্রীষ্ম প্রধান দেশে ইউরোপীয়দিগের অপর পোষাক অপেক্ষা যদিও উহাদের হ্যাট সর্বাপেক্ষা আবশ্যকীয় সুবিধা জনক ও সুখকর; তথাপি বিজাতীয় এবং বিদেশীয় বলিয়া উহা অনেকেই পরিতে চাহেন না বা ভালবাসেন না, কিন্তু তৎপরিবর্তে এই “শম্সিয়া”র প্রচলন হইলে, কাহারেই ইহা পরিতে আপত্তি হইবে না।
পার্বত্য প্রদেশ বলিয়া এখানকার বায়ু নিতান্ত শুষ্ক। বায়ুতে জলীয় বাষ্পের খুব অভাব। রৌদ্রে শরীর পুড়িয়া যাইতেছিল বটে, কিন্তু ঘর্ম খুব কমই নিৰ্গত হইতেছিল । মধ্যে মধ্যে মুখে রৌদ্র লাগায় মুখের চর্ম পুড়িয়া যাইতে লাগিল।
যাহা হউক, আমরা দ্রুত অশ্ব চালাইয়া বেলা ২টার সময় চিপলীক নামক একটি সামরিক আড্ডায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম৷ আমরা ক্ষুৎপিপাসায় যারপর নাই ক্লান্ত ছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া নিকটস্থ একটি নির্ঝরের স্ফটিক স্বচ্ছ নির্মল জলে হস্ত মুখাদি প্রক্ষালন এবং কিঞ্চিত জলপান করিয়া স্নিগ্ধ হইলাম। এখানকার কর্নেল আমাদিগকে পরম সমাদরে গ্রহণ করিলেন। কার্পেট মণ্ডিত গৃহতলে যে কয়েক খান চেয়ার ও সোফা ছিল, তাহাতে আমাদের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় কয়েক জন কার্পেটেই স্থান গ্রহণ করিয়া অর্ধশায়িতাবস্থায় বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। অত্যল্প সময় মধ্যেই আমাদিগকে কফি এবং চুরুট দেওয়া হইল। তৎপর আমাদের জন্য একটি বৃহৎ বারকশ করিয়া উৎকৃষ্ট পাউরুটি, পনির, সিদ্ধ-ডিম্ব, দধি এবং কমলা লেবু আনীত হইল৷ আমরা সকলে সেই কার্পেট মণ্ডিত গৃহতলে বৃত্তাকারে বসিয়া সেই বারেকাশ হইতে খাদ্য লইয়া খাইতে লাগিলাম। তুর্কী বন্ধুরাও আমাদের সহিত আহার করিলেন। আহারান্তে নিতান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আর বিশ্রাম করিবার অবসর হইল না। অবিলম্বে অশ্বারোহণ করিয়া সুবিখ্যাত ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ দর্শন মানসে যাত্রা করিলাম। জনশূন্য প্রান্তর ও বনভূমি অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর গমন করিবার পরে আমরা এক সামরিক আড্ডার নিকটবর্তী হইলাম। এখানে বহুসংখ্যক বলিষ্ঠ আরব ও কুদ সৈন্যকে দেখিতে পাইলাম । আমাদিগকে দেখিয়া কর্নেল এবং তাঁহার সমস্ত সৈন্য শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দণ্ডায়মান হইয়া অভিবাদন ও সম্মান প্রদর্শন পূর্বক পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। অফিসার ও সৈন্যেরা আসিয়া ঘোড়া থামাইয়া আমাদিগকে নামাইয়া লইলেন। শীতল জল এবং কফি দিয়া আমাদিগকে অভ্যর্থনা করা হইল। আরব সর্দারেরা আমাদিগের আগমনে যারপর নাই আনন্দ এবং সন্তোষ জ্ঞাপন করিতে লাগিলেন । একটি বৃক্ষের শীতল ছায়ায় কার্পেট বিছাইয়া আরব সর্দারেরা আমাদিগের সহিত প্রফুল্ল চিত্তে কথোপকথন করিতে লাগিলেন। আমরা সুদূর হিন্দুস্থান হইতে আজ এই জাতীয় দুর্দিনে যে তাঁহাদের তত্ত্ব লইতে আসিয়াছি, সেজন্য তাঁহারা যেরূপ গভীর কৃতজ্ঞতা ও আনন্দ প্রকাশ করিলেন, তাহা ভাষায় অপ্রকাশ্য। তাঁহাদের চোখে মুখে যে প্রীতি ও হর্ষের বিকাশ দেখিলাম, তাহাতে আমার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। আরবদিগের অতিথি পরায়ণতা এবং ভ্রাতৃভাবের গল্প ও কাহিনী অনেক বহি- পুস্তকেই পাঠ করিয়া ছিলাম, কিন্তু আজ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া বিস্মিত হইয়া গেলাম। আমরা আহার করিয়া আসিয়াছিলাম, তথাপি আহারের আয়োজন দেখিয়া অনেক অনুনয় বিনয়ে তাঁহাদিগকে নিবৃত্ত করিলাম। আরব সর্দারগণ ব্যাকুল চিত্তে ভারতবর্ষের অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। এই জাতীয় দুর্দিনে ভারতীয় মুসলমানদের আকুলতার কথা শুনিয়া সকলে হস্তোত্তলন পূর্বক খোদার নিকট মোনাজাত করিতে লাগিলেন। আমাদের রুদ্ধ হৃদয় উন্মুক্ত হইয়া গেল । মরক্কো, পারস্য, মিসর, তুরস্ক, তুরান (তাতার) প্রভৃতি মুসলিম রাজ্য সমূহের দুঃখ দুর্দশার চরমাবস্থার কথা আলোচনা করিতে করিতে যখন আমরা বলিলাম যে, “এই ভীষণ বিপদের বজ্রাঘাত, আমাদের মঙ্গল ও মুক্তির পথই মুক্ত করিতেছে।” তখন সকলেই আবেগভরে “ইনশা আল্লাহ” “ইন্শা আল্লাহ” বলিয়া উঠিলেন। এই পবিত্র স্থান চিরদিন হৃদয়ের অন্তঃস্থল অধিকার করিয়া থাকিবে । ইহা কখনও ভুলিবার নয় ।
অতঃপর আমরা যখন বিদায় গ্রহণের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম, তখন আরব সর্দারগণ নিজ নিজ তরবারী কোষ হইতে খুলিয়া লইয়া নিতান্ত বিনীত ভাবে বলিলেন,- “আমরা দরিদ্র যোদ্ধা। আপনাদিগকে উপহার দিবার মত আমাদের নিকট কিছুই নাই। তবে এই সামান্য তরবারী দয়া করিয়া গ্রহণ করিলে নিতান্ত বাধিত ও প্রীত হইব।” বলা বাহুল্য আরব সর্দারদিগের সেই সমস্ত তরবারী অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। তারপর উহা তাঁহাদিগের পরম যত্নের জিনিসও বটে! আরবদিগের উদারতা এবং মহানুভবতায় আমরা মুগ্ধ হইয়া গেলাম । পুনঃ পুনঃ ধন্যবাদের সহিত আমরা তাহাতে অসম্মতি প্রকাশ করিলাম । কিন্তু কর্নেল তাঁহার নিজের সুদীর্ঘ তরবারী খানি আমাকে লইবার জন্য বিশেষ পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। আমি ধন্যবাদের সহিত প্রত্যাখ্যান করিলে, তিনি পুনঃ বলিলেন, “আপনার ভ্রাতার স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ এই শমশের (তরবারী) গ্রহণ করুন।”
অগত্যা আমাকে বাধ্য হইয়া বলিতে হইল যে, “বিনা লাইসেন্স বা পাসে তরবারী লইয়া ভারতে প্রবেশ করিলে, আমাকে বিপদগ্রস্ত হইতে হইবে।”
তরবারীর জন্য “লাইসেন্স” আবশ্যক শুনিয়া আরব বীর, মুহূর্তের জন্য ভ্রুকুঞ্চিত করিলেন। অতঃপর নিরাশার দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া তরবারী কোষবদ্ধ করিলেন । অনন্তর আমাদের অশ্ব সকল আনীত হইলে আরব বীরগণ জনে জনে আমাদিগকে চুম্বন করিয়া গভীর প্রীতি ও মমতার সহিত দুঃখিত চিত্তে বিদায় দান করিলেন
ট্রয় দর্শন
অনন্তর আমরা দ্রুতবেগে অশ্ব ছুটাইয়া ২০ মিনিটের মধ্যে ট্রয় নগরীর ধ্বংসের নিকটবর্তী হইলাম। দেখিলাম, এই ধ্বংসের নিকটেই দক্ষিণ দিকে সৈন্যদের এক ক্যাম্প পড়িয়াছে। সেখানে বহুসংখ্যক সৈন্য পরিখা খনন কার্যে নিযুক্ত আছে। অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া আমরা ট্রয়ের ধ্বংস দেখিতে লাগিলাম । মার্বেল পাথরের কতিপয় ভগ্ন স্তম্ভ, কয়েকটা প্রাসাদ ও তোরণ, মাটি খুঁড়িয়া বাহির করা হইয়াছে। নিকটে আরও কয়েকটা উচ্চ মৃত্তিকা স্তুপ দেখা গেল। অনুমানে বোধ হইল যে, তাহার নিম্নেও অনেক প্রাচীন কীর্তি প্রোথিত আছে। মৃত্তিকা খুঁড়িয়া যে অংশ বাহির করা হইয়াছে, তাহার প্রাসাদ ও স্তম্ভের গঠনের সহিত গ্রীক স্থাপত্যের কোনও পার্থক্য পরিলক্ষিত হইল না । অট্টালিকা ও প্রাচীর সমস্তই শ্বেত মর্মর নির্মিত। একটি চৌবাচ্চার মত স্থানও দেখিতে পাইলাম ৷ একটি স্থানে বৃত্তাকারে গ্যালারি-সাজান গোল-ঘর বা য়্যাম্পিথিয়েটারের (Amphi Theatre) মত দেখিতে পাইলাম। তাহা কি উদ্দেশ্যে নির্মিত হইয়াছিল, তাহা ভাল করিয়া বুঝিতে পারিলাম না। আরও কয়েকটি ভগ্ন অট্টালিকার কিয়দংশ পরিদৃষ্ট হইল। স্তম্ভগুলি এক একটি আস্ত পাথর কাটিয়া নির্মাণ করা হইয়াছিল। ধ্বংসাবশেষ যাহা দেখা গেল, তাহাতে ইহা যে একটি খুব বড় রাজবাড়ি ছিল, তাহা বোধ হইল না। তবে মৃত্তিকার নীচে কতদূর পর্যন্ত ধ্বংসাবশেষ আছে, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য! তুর্কীরা ট্রয়ের যে সীমা নির্দেশ করিলেন, তাহাতে ইহা যে ক্ষুদ্র নগর ছিল, তাহা স্পষ্টই উপলব্ধি হইল। গ্রীক সুন্দরী রাজকুমারী হেলেনের যে অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া ট্রোজান যুবরাজ ম্যানিলুস তাঁহাকে অপহরণ করিয়া আনিয়াছিলেন, সেই সৌন্দর্যই এই প্রাচীন উন্নতি-শীল নগরী এবং ইহার স্থাপন কর্তা ট্রোজান জাতির ধ্বংসের কারণ। কথিত আছে, রাজকুমারী হেলেনের অপহরণে বীর্যবন্ত গ্রীকগণ নিতান্ত ক্ষিপ্ত হইয়া দেশের সমস্ত যুবক ও সৈন্য সহ ট্রোজান রাজ্য আক্রমণ করেন এবং দীর্ঘ দশ বৎসর যুদ্ধের পরে ট্রোজানদিগের সর্বস্ব ধ্বংস এবং তাহাদিগকে সমূলে নির্মূল করিয়া গ্রীক বীরগণ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এই যুদ্ধে গ্রীকদিগেরও অধিকাংশ যোদ্ধা এবং বীর পুরুষই নিহত হইয়াছিলেন। অমর কবি হোমার, তাঁহার জগদ্বিখ্যাত “ইলিয়াড” কাব্যে এই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। হেলেন হরণরূপ মহাপাপে লিপ্ত না হইলে হয়ত আজও ট্রয়ের গৌরব পতাকা পৃথিবী পৃষ্ঠে উড্ডীয়মান থাকিত। পাপের পরিণাম ধ্বংস ব্যতীত আরকি?
ভিডিও: বর্তমান সময়ের ট্রয় নগরী
ট্রয়ের ধ্বংসস্তুপ হইতে সমুদ্রের নীল জলরাশির রবিকরোজ্জল শোভা বড়ই চিত্তাকর্ষক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । আমি কল্পনার পটে প্রাচীন ট্রোজান গ্রীক এবং ফিনিশীয়ানদিগের সেই আদিম যুগের পাইন যুক্ত বিচিত্র আকারের অর্ণবযান সকল সমুদ্র বক্ষে যেন দেখিতে পাইলাম। এই সমস্ত পরিশ্রমী, বলিষ্ঠ এবং সাহসী জাতি ৪/৫ সহস্র বৎসর পূর্বে সেই বিজ্ঞানের প্রথম উন্মেষের প্রথম প্রভাতে কেমন ধীরে ধীরে উন্নতির পথে সোপানে সোপানে আরোহণ করিতেছে, অতীতে দৃষ্টি ফিরাইয়া তাহাই দেখিতে লাগিলাম। আমার কাছে সে দৃশ্য বড়ই মনোহর এবং ভাবপূর্ণ বলিয়া বিবেচিত হইল । কত সহস্র সহস্র বলের, কত লক্ষ চিন্তাশীল কর্মী পুরুষের চেষ্টা এবং সাধনার ফলে আমরা বর্তমান সভ্যতার প্রদীপ্ত মহিমা দেখিতে পাইতেছি ইত্যাদি বিষয় চিন্তা করিয়া আমার মন প্রাচীন জাতি সকলের উদ্দেশ্যে ভক্তিভরে নত হইয়া পড়িল ।
অতঃপর আমরা অপরাহ্ন ৩টার সময় ট্রয়ের ধ্বংসস্তূপের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া দার্দানেলিসের পথ অবলম্বন করিলাম। অন্যূন ১২ মাইল পথ অতিক্রম করিয়া “বনারবাসি” নামক একখানি গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইলাম । এই গ্রামটি শ্যামল তরুরাজিতে সুন্দরভাবে পরিবেষ্টিত। এই গ্রামে ৪০টি জলের প্রস্রবণ আছে। আমাদের পরিদৃষ্ট কি এশিয়া কি ইউরোপ কোথাও কোন গ্রামে এত কূপও দেখি নাই ।
গ্রামের লোকজন আমাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিতে বলিল। কিন্তু এখনও আমাদিগকে বহু পথ অতিক্রম করিতে হইবে বলিয়া, তাহাদিগের অনুরোধ রক্ষা করিতে পারিলাম না। অশ্বপৃষ্ঠেই জলপান করিয়া তথা হইতে আবার ধাবিত হইলাম। তৎপর জলাভূমি এবং বন ও ময়দান অতিক্রম করিয়া আজগ নামক একখানি গ্রামে যাইয়া পহুঁছি। তৎপর আরন কুই নামক সুপ্রসিদ্ধ গ্রীক পল্লীতে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিয়া সন্ধ্যারাগ রঞ্জিত মর্মরা সাগরের এবং তাহার তীরস্থ বনরাজির একটানা সবুজ শোভা দেখিতে দেখিতে দ্রুতবেগে অশ্ব ছুটাইয়া সন্ধ্যার সময় দার্দানেলিস শহরে যাইয়া উপনীত হইলাম ।
তুরস্ক ভ্রমণ / মাসিক আল এস্লাম, ৪র্থ ভাগ, ৫ম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩২৫ ও ৯ম সংখ্যা, পৌষ, ১৩২৫।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর রচনাবলীতে এই ভ্রমণকাহিনী সহ তার যাবতীয় রচনা পড়তে পারবেন।