দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার তাঁতে বোনা লুঙ্গি দেশের সীমা পার হয়ে এখন রপ্তানী হচ্ছে বিদেশে। এরই মধ্যে দেশের সীমা ছাড়িয়ে দোহারের জয়পাড়ার লুঙ্গি বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। বিদেশ থেকে আসছে লুঙ্গীর অর্ডার।
আনুমানিক ১০০ বছর আগে তাঁতে বোনা লুঙ্গির গোড়াপত্তন হয়েছিল দোহার নবাবগঞ্জে। সেই থেকে নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে লুঙ্গি তৈরি করে চলেছেন এখানকার তাঁতিরা। এক সময় খুবই জমজমাট ছিল দোহারের জয়পাড়া লুঙ্গির হাট।
কিন্তু আধুনিক মেশিনে প্রস্তুত লুঙ্গির সাথে হাতে বোনা লুঙ্গি প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় দিন দিন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তাঁতশিল্প। ফলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দোহারের তাঁতিরা। এক সময়ে জয়পাড়া লুঙ্গির হাটকে কেন্দ্র করে উৎসবে পরিণত হত। দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আগত পাইকারদের ভিড়ে সরগরম থাকতো সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারের বিকেলটা। কিন্তু সেটা এখন পরিনত হয়েছে ইতিহাসে।
সারা দেশে লুঙ্গির যে ক’টি হাট রয়েছে, তার মধ্যে জয়পাড়ার লুঙ্গির হাট প্রসিদ্ধ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা লুঙ্গি কিনতে ছুটে আসেন এই হাটে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে এখন ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। প্রায় ৪ দিন ৮০ ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তৈরি হয় এক ভিম (ছয়টি) লুঙ্গি। প্রতিটি ভিমের দাম পাইকারী মূল্যে ২৪শ’ (নিম্ন মানের) থেকে প্রায় ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত (ভাল মানের) (২০১৫ সাল)।
লুঙ্গিগুলো দোহার ও নবাবগঞ্জে প্রায় প্রত্যেকটি শপিংমলে সহজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের চেক লুঙ্গি এবং খাড়া স্ট্রিপ লুঙ্গি ও একক সাদালুঙ্গিসহ বিভিন্ন রংয়ের চোখ ধাঁধানো লুঙ্গি সাজানো থাকে দোকানের তাকগুলোতে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য তাদের সাইজ ও পছন্দমত লু্ঙ্গি তৈরি করে থাকে দোহার ও নবাবগঞ্জের কারিগররা। সেই হিসাবে প্রতিটি লুঙ্গি বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
স্থানীয় হাট ও মানভেদে লুঙ্গির দাম কমবেশি হয়ে থাকে। তবে তাঁতিরা বেশি বুনছেন ৬০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা দামের লুঙ্গি। তা ছাড়া ঈদের আগেও বাজারে লুঙ্গির দাম বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই।
মেঘুলা তাঁতপল্লীর নারী কারিগররা জানান, শিশুকাল থেকে বাবার বাড়িতে কাজ শিখে এসে স্বামীর সংসারের উন্নয়নে নিজেরাও তাঁতের ঘরোয়া কাজ করছি। নিজেদের কাজ শেষে পরের বাড়ির তাঁতের কাজ করে নিজেদের হাত খরচও চালাচ্ছেন তাঁতপল্লীর গৃহিণীরা। যারা তাঁতের কাজ করেন এখানকার স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় ‘কারিকর’। মূলত ‘কারিগর’ শব্দটি মৌখিক ভাষায় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ‘কারিকর’-এ রূপান্তরিত হয়েছে বলে জানা যায়।
স্থানীয় কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুতার মূল্য বৃদ্ধি, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি, যুবকদের বিদেশ গমন ও পাওয়ার লুম যন্ত্র স্থাপনের ফলে জয়পাড়া এলাকার অনেক তাঁতি পরিবারই তাঁতের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। স্থানীয় তাঁতি মোজ্জামেল জানান, এ অঞ্চলের তাঁতে বুনানো লুঙ্গি আরামদায়ক ও টেকসই বেশি হওয়ার কারণে সারা দেশে এর কদর রয়েছে বেশ। তাই নকলের ভিড়ে দোহারের লুঙ্গির চাহিদা সব সময়ই সমান।
এ ব্যাপারে কথা হয় দোহার উপজেলার দক্ষিণ জয়পাড়া গ্রামের তাঁতি মোঃ শহীদের সাথে। তিনি জানান, বর্তমানে লুঙ্গির বাজার খুবই খারাপ। এক সময় লুঙ্গি তৈরি করে খুবই সচ্ছল ছিল তাঁতিরা। বর্তমানে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং লুঙ্গির দাম কমে যাওয়ায় কোনোরকম বেঁচে আছে এ তাঁতশিল্পের কারিগররা।
স্থানীয় কারিগরদের অভিযোগ, সুতার মূল্য ও শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। সে হিসেবে বাড়ে নি লুঙ্গির দাম। ফলে ঈদের সময় ছাড়া এ ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছে না তাঁতশিল্প মালিকরা। সরকারি সহযোগিতা না পেলে হারিয়ে যাবে বাপ-দাদার এই পুরনো পেশা।
ইকরাশী সড়ক পাড় গ্রামের তাঁতি আনোয়ার হোসেন জানান, পরিশ্রম অনুযায়ী সারা বছর তেমন একটা লাভ না হলেও ঈদে লুঙ্গির চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় লাভ হয় বেশি।
দোহার উপজেলার মালিকান্দা গ্রামের তাঁতি মো. লিটন মিয়া জানান, আমাদের দেশের বড় বড় লুঙ্গির ব্যবসায়ীরা পাবনার লুঙ্গি কমদামে ক্রয় করে দোহারের লুঙ্গি বলে বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে একদিকে গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছে অন্যদিকে দোহারের লুঙ্গির সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
দোহার-নবাবগঞ্জ উইভার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, দেশের যতগুলো লুঙ্গির ব্র্যান্ড রয়েছে তারা সবাই পাবনার লুঙ্গিকে দোহারের লুঙ্গি বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
জয়পাড়ার লুঙ্গি বিদেশেও যাচ্ছে, নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে এটাই শুধু আশার বিষয়, কিন্তু বাইরে থেকে আনা বা পাওয়ারলুমের নামে যেন চালানো না হয় সেই আবেদনও রাখছেন তাঁতীরা।