দোহার-নবাবগঞ্জ থেকে গ্রাহকদের ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

357

ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা মাল্টিপারপাস কোম্পানিগুলো দোহার ও নবাবগঞ্জ থেকে গত চার মাসে গ্রাহকদের প্রায় ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেরতে পাবার আশায় প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধ কার্যালয়ের সামনে ভিড় জমাচ্ছেন। সমাবেশ করছেন, স্বারকলিপি দিচ্ছেন কিন্তু ফিরে পাচ্ছেন না টাকা। আর টাকা ফেরত না পাওয়ায় অনেকের সংসারে দেখা দিয়েছে অশান্তি।

উল্লেখ্য সম্প্রতি দোহার-নবাবগঞ্জ এলাকা থেকে ডেসটিনি, আল-আকসা, ইসলামিক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. এবং আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. সান গ্রুপ ও দি ম্যাক্সিম গ্রুপ গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত প্রায় ৪০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়। আর কোম্পানি লাপাত্তা হওয়ায় চরম আতঙ্কে ও নিরাপত্তাহীনতায় আছেন স্থানীয় কর্মচারী ও কমিশনভোগী এজেন্টরা।

নিউজ৩৯ সূত্রে জানা গেছে, নবাবগঞ্জ উপজেলায় বাগমারা বাজারের পাশে মুন্নাফ বেপারীর আরিফ সুপার মার্কেটের তিনতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় অবস্থিত আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও গালিমপুর বাজারে আল-আকসা ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড উপজেলা থেকে গ্রাহকদের প্রায় ২০ কোটি নিয়ে উধাও হয়েছে গেছে।

গত দুই মাসের ব্যবধানে চারটি মাল্টিপারপাস কোম্পানি এখানকার গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার ফলে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বাকি সব মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে বিনিয়োগকারী গ্রাহকরা। প্রতিদিনই এসব প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য একই সঙ্গে গ্রাহকরা ভিড় জমাচ্ছেন।

প্রতারণার শিকার বড়গাঁও খাদিজা (২৮) বলেন, ‘স্বামীকে না জানিয়ে আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে ১১ লাখ টাকা জমা রেখেছি। জমাকৃত টাকা ফেরত না পাওয়ায় স্বামী আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আমার সংসার ভাঙার উপক্রম।’

আরেক ভুক্তভোগী গালিমপুর এলাকার আবুল কালাম (৫০) মনে করেন, স্থানীয় সমবায় অফিস ঠিকমতো মনিটরিং না করায় অবৈধভাবে মাল্টিপারপাস কোম্পানিগুলো ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব থেকে ফেরার পর বাকি জীবন শান্তিতে দেশে কাটাব বলে সঞ্চয়ের সাড়ে ১৫ লাখ টাকা আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের বাগমারা শাখায় জমা রেখেছি। কিন্তু টাকা নিয়ে এখন তারা লাপাত্তা।’

অন্য খবর  দোহারে সমাজসেবক বরকত উল্লাহ্'র ত্রাণ বিতরণ

সান গ্রুপে পল্লী সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডে বিনিয়োগকারী দোহার শাখার প্রশিকা কর্মকর্তা আবদুস সালাম জানান, গত ২ মাস আগে ৪ লাখ ৩০,০০০ টাকা জমা রাখেন।

একইভাবে আইডিয়ালের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সব সঞ্চয় খুইয়েছেন আগলা গ্রামের ইদ্রিস মিয়া (৬ লাখ টাকা), ছাতিয়া গ্রামের খলিল (২ লাখ টাকা), বড়গাঁও গ্রামের নাজমা বেগম (৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা) ও দিঘিরপাড় গ্রামের হারুন-উর-রশীদের স্ত্রী বিউটি (৫ লাখ টাকা)।

এদিকে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দোহার উপজেলার জয়পাড়া বাজারে মৃধা প্লাজায় অবস্থিত সান গ্রুপ অব কোম্পানিজ লিমিটেডের ‘পল্লী সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড’ এবং দ্য ম্যাক্সিম গ্রুপের ‘ম্যাক্সিম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের প্রায় ৮ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে।

জয়পাড়া ডিগ্রি কলেজের কেমিস্ট্রির প্রভাষক কেরামত আলী জানান, ৫ মাস আগে তিনিও ৫ লাখ টাকা জমা রাখেন। অপরদিকে, দি ম্যাক্সিম গ্রুপের ম্যাক্সিম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেডে বিনিয়োগকারী বানাঘাটা গ্রামের নুরুল হক জানান, ১ বছর আগে তিনি ৫ লাখ টাকা জমা রেখেছেন।

আরেকজন গ্রাহক নিলুফা আক্তার রেশমা জানান, ব্যাংকের চেয়ে বেশি লাভ পাওয়ার আশায় তিনি ৩ লাখ ৩৫,০০০ টাকা জমা রেখেছেন।

দোহার উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা এসএম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে অবৈধ পন্থায় রাতারাতি গ্রাহকদের কাছ থেকে ডিপিএসের নামে সঞ্চয় করে।’

নবাবগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমা আক্তার বলেন, ‘ঢাকা জেলা হতে নিবন্ধন হওয়ার কারণে পূর্বে আমাদের মনিটরিং করার কোনো ক্ষমতা ছিল না। এ সুযোগে মাল্টিপারপাসগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে।’

নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’

অন্য খবর  নবাবগঞ্জে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় নিহত ১, পরিবারের প্রশ্ন তারা এখন কিভাবে চলবে?

নিউজ৩৯ অনুসন্ধানী প্রতিবেদক বিষয়টি আগেভাগেই প্রসাশনের নজরে আনতে জোর তাগিদ দিয়েছিল। গত ২০ তারিখে বিষয়টি দোহার থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনকে জানালে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে একটি জরুরি বৈঠকে আছেন বলে জানান এবং পরে ফোন দিবেন বললেও তিনি ব্যাস্ততার কারণে ভুলে যাওয়ায় তা দেননি।

বর্তমানে গ্রাহকর বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় কার্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়। তখন সেখানে গ্রাহকদের ভীড় দেখা গেছে। তাদের অনেককে হতাশায় ভোগছেন।

এ ব্যাপারে সান গ্রুপ অফ কোম্পানিজ লিমিটেড দোহার শাখা ব্যবস্থাপক ইয়াকুব আলীর মোবাইলে এবং দি ম্যাক্সিম গ্রুপের দোহার শাখা ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাকের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায় নি। আব্দুর রাজ্জাক বর্তমানে পলাতক আছেন বলে জানা গেছে।

তবে জানা গেছে দি ম্যাক্সিম গ্রুপের দোহার শাখা পরিচালককে কে বা কারা গোপনে অপহরণ করার পর তাকে দিয়ে সাদা কাগজ ও দলিলে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে কতিপয় গ্রাহক, এমন অভিযোগ করেন তার পারিবারিক লোকজন। তারা বলেন, কোম্পানির এম ডি পালিয়ে যাওয়ায় তারা এই বিপাকে পড়েছেন। না হলে কোম্পানির যে সম্পত্তি আছে তা দিয়ে গ্রাহককদের দায়-দেনা মেটানো সম্ভব। কিন্তু এমডি’র কোনো খোজ না থাকায় তারা তা বিক্রিও করতে পারছেন না। উপরন্তু পরিচালকেরা আছেন বিপাকে।

দোহার থানার ওসি (তদন্ত) কামরুল ইসলাম মিয়া জানান, অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল আমীন বলেন, বিষয়টির ব্যাপরি অবহিত আছি এবং কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে যেন আমানতকারিদের যেন ক্ষতি না হয়। তিনি যারা অসাধু ব্যবসায়ির মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে অধিক লাভের আশায় টাকা জমা করেন, তাদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

আপনার মতামত দিন