লিবিয়ার কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শাসক। ১৯৪২ সালে লিবিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের সিরতে এক যাযাবর গোত্রে জন্ম নেন গাদ্দাফি। বেনগাজি ইউনিভার্সিটিতে ভূগোল বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও মাঝপথে তা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন যুবক গাদ্দাফি। ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার তৎকালীন রাজা ইদ্রিসকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন গাদ্দাফি। ভিন্নমতালম্বীদের কঠোরভাবে দমন করে খনিজ তেল সমৃদ্ধ লিবিয়ার দখল ধরে রাখেন তিনি।
ক্ষমতা দখলের পরে তিনি ইসলামঘেঁষা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্যান-আরব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। এসময় দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তি মালিকানায় রাখার অনুমতি দেন।
১৯৭৭ সালে দেশের নাম বদলে গ্রেট সোস্যালিস্ট পপুলার লিবিয়ান জামাহিরিয়াহ (জনতার রাষ্ট্র) রাখেন। এসময় দেশের সাধারণ মানুষদের পার্লামেন্টে তাদের মতামত জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তবে তার বিরুদ্ধে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার জন্য হাজার হাজার মানুষকে অবৈধভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ও বন্দি করে রাখার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে আরব বিশ্বের তৎকালীন বিবদমান দুই প্রতিপক্ষ মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাদের মুখোমুখি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন গাদ্দাফি।
তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্কট সমাধানে অত্যন্ত কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আরব দেশ তার সমালোচনা করে। এসময় থেকে তার প্যান-আরব নীতি পরিবর্তিত হয়ে প্যান-আফ্রিকা পরিকল্পনায় রূপ নেয়।
তার ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকা গঠনের উদ্যোগই পরবর্তী সময়ে আফ্রিকান ইউনিয়নের জন্ম দেয়।
তবে পশ্চিমা বিশ্বে সবসময়ই গাদ্দাফিকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে দেখা হয়। কলাম্বিয়ার রেভ্যুলেশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলাম্বিয়া (ফার্ক) এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের আইরিশ রিপাবলিকান আর্মিকে (আইআরএ) সমর্থন দেয়া অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
১৯৮৬ সালে জার্মানির বার্লিনে একটি নাইটক্লাবে বোমা হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই সেনা সদস্য নিহতের ঘটনায় লিবিয়ার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এসময় গাদ্দাফিকে ‘পাগলা কুকুর’ বলেও অভিহিত করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান।
এ ঘটনার পরে ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় গাদ্দাফির পালিত মেয়েসহ ৩৫ জন লিবীয় নিহত হয়।
১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবিতে প্যান অ্যাম এয়ারলাইন্সের একটি জাম্বো জেট বিমানে বোমা হামলায় ২৭০ জন নিহতের ঘটনায় গাদ্দাফির জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার পরিকল্পনা করার জন্য অভিযুক্ত হন একজন লিবীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
বহুবছর ধরে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন তিনি। এর ফলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয় লিবিয়াকে।
২০০৩ সালে গাদ্দাফি প্রশাসন এ বোমা হামলার দায় স্বীকার করে নেয়। এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের ১ কোটি ডলার পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হন তিনি।
এছাড়া তার দখলে থাকা গণবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার ঘোষণাও দেন এসময়। এর ফলে তার প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ লিবিয়ার উপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এর ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে লিবিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ায় লিবিয়ার অর্থনীতি বেশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
তবে ২০০৯ সালে অভিযুক্ত লিবীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরলে গাদ্দাফির পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হলে আবারও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সমালোচনার মুখে পড়েন গাদ্দাফি।
২০০৯ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যান গাদ্দাফি। এ অধিবেশনে ১৫ মিনিটের বদলে দেড় ঘণ্টা ভাষণ দেন, জাতিসংঘের নীতিমালার অনুলিপি ছিঁড়ে ফেলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সাথে তুলনা করেন।
একইসাথে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোর জন্য ৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
২০১০ সালে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ইতালি সফর করেন গাদ্দাফি। কিন্তু সফরের সময় প্রায় দু’শ ইতালীয় নারীকে ইসলামধর্ম গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালে গাদ্দাফির মূল উদ্দেশ্য ঢাকা পড়ে যায়।
মোয়াম্মার আল গাদ্দাফি রচিত গ্রন্থ হলো কিতাবিল আখদার বা দ্য দিন বুক বা সবুজ গ্রন্থ। এটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। তিন খণ্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থে সমাজ এবং রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধানে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত হয়েছে। এটিই মূলত লিবিয়ার সংবিধান।
ইংরেজিতে মোয়াম্মার আল গাদ্দাফির নামের বানান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে London Evening Standard পত্রিকায় তার নামের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে সম্ভাব্য ৩৭টি বানানের কথা উল্লেখ করা হয়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফির শাসনের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় গণআন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু ওই গণআন্দোলনকে তেমন আমল না দিয়ে কঠোরহস্তে দমনের চেষ্টা চালান গাদ্দাফি। পরবর্তী সময়ে এই গণআন্দোলন গণবিদ্রোহে রূপ নেয় যা দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। এক পর্যায়ে গাদ্দাফি রাজধানী ত্রিপোলি থেকে পালিয়ে যান।