যুগান্তরের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ইমেজ সংকটে আব্দুল মান্নান খান

480

সাবেক গৃহায়ন ও গনপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানকে নিয়ে আবার প্রতিবেদন করেছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা যুগান্তর। ক্রমাগত গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রনালয় নিয়ে প্রতিবেদনের কারনে ইমেজ হারাচ্ছেন আব্দুল মান্নান খান। নিউজ৩৯ তার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলো।

সাবেক গৃহায়ন ও পূর্ত প্রতিমন্ত্রী এবং নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-১ আসনের (দোহার-নবাবগঞ্জ) এমপি আবদুল মান্নান খানের পাঁচ বছরের ব্যবধানে সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। পাঁচ বছর আগে নিজের কাছে থাকা নগদ ৫১ হাজার টাকা এখন ৪০ লাখে পরিণত হয়েছে। আর প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগে ব্যাংকে মাত্র ১৭শ’ টাকা গচ্ছিত থাকলেও এখন শুধু এফডিআরের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। আগে গাড়ি ছিল না, এখন রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যের পাজেরো গাড়ি। আগে কোনো ফ্ল্যাট ছিল না। থাকতেন কলাবাগানের ভাড়া বাসায়। এখন সেখানে একাধিক ফ্ল্যাট। আর গ্রামের বাড়ির টিনের তৈরি চৌচালা ঘরের পাশে তৈরি হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের সুরম্য অট্টালিকা। স্ত্রীর নামেও জমা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও আছে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া প্রদর্শিত সম্পদ বিবরণী থেকে এমন বিস্ময়কর তথ্য জানা গেছে। এছাড়া যদি এর বাইরে অপ্রদর্শিত কোনো সম্পদ ও নগদ অর্থ থাকে তাহলে হতবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

নিজের ও নির্ভরশীলদের আয় : সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের আয়ের উৎস সম্পর্কিত বিবরণীতে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে তার কৃষি খাতে বার্ষিক আয় ছিল ১৫ হাজার টাকা, পাঁচ বছর পর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ব্যবসা বলতে তখন তার কিছুই ছিল না। এখন তার নিজের ব্যবসা না থাকলেও নির্ভরশীলদের ব্যবসা থেকে বছরে আয় হয় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। পাঁচ বছর আগে তার কোনো শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত ছিল না। এখন সেখানে প্রদর্শিত এসব অর্থ থেকেই বছরে আয় করেন ১ লাখ ১১ হাজার ৯০৮ টাকা এবং তার ওপর নির্ভরশীলরা এই খাত থেকে আয় করেন ১১ হাজার ৮৪৭ টাকা। পাঁচ বছর আগে আইন পেশা থেকে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর আয় ২ লাখ টাকা। এখন তার ওপর নির্ভরশীলদের কোনো আয় দেখানো না হলেও নিজের আয় দেখানো হয়েছে ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬শ’ টাকা। এই আয়ের বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া না হলেও সম্ভবত তিনি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বছরে যে বেতন-ভাতা পেয়েছেন সেই হিসাব দেখানো হয়েছে। পাঁচ বছর আগে তার অন্য কোনো আয় দেখানো না হলেও এবার বলা হয়েছে, তিনি মৎস্য ও রেমিটেন্স থেকে বছরে পেয়েছেন ১ কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ২২৭ টাকা। এছাড়া এ খাতে তার ওপর নির্ভরশীলদের বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬৫৫ টাকা। তবে এ প্রসঙ্গে কোনো ব্যাখ্যা কিংবা মৎস্য ও রেমিটেন্স থেকে পৃথকভাবে আসা টাকার হিসাব দেখানো হয়নি। বিদেশ থেকে কারা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন তাও বলা নেই। হয়তো আয়কর ফাইলে থাকতে পারে। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, পাঁচ বছর আগে মৎস্য ও রেমিটেন্স খাতে কোনো অর্থের উৎস দেখানো না হলেও প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর এ দুটি খাত থেকে মোটা অংকের অর্থের জোগান হয়েছে।

অন্য খবর  ইছামতির ভাঙ্গন, মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা

অস্থাবর সম্পদ : অস্থাবর সম্পদ বিবরণীর হিসাবে পাঁচ বছর আগে তার নিজের কাছে নগদ টাকা ছিল মাত্র ৫১ হাজার এবং স্ত্রীর কাছে ২৫ হাজার টাকা। আর পাঁচ বছর পরে এখন তার নিজের কাছে নগদ টাকার পরিমাণ ৪০ লাখ এবং স্ত্রীর কাছে ১৫ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে কোনো শেয়ার না থাকলেও এখন রয়েছে ২ লাখ টাকার শেয়ার। পাঁচ বছর আগে তার ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৯১ টাকা এবং এখন পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানত ও বিনিয়োগের মধ্যে সঞ্চয়পত্র ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও এফডিআর রয়েছে ৩৭ লাখ টাকার। এছাড়া তার নামে রয়েছে সাড়ে ৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। আগে তার কোনো গাড়ি ছিল না। এখন প্রায় ৫০ লাখ টাকা দামের একটি পাজেরো গাড়ি রয়েছে, যা তিনি প্রতিমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে কিনেছেন। পাঁচ বছর আগে তার কেনা স্বর্ণালংকারের পরিমাণ ছিল ১৫ ভরি এবং স্ত্রীর ২০ ভরি (বিয়ের সময় পাওয়া)। এখন নিজের অর্জনের ক্ষেত্রে আগের পরিমাণ দেখানো হলেও স্ত্রীর স্বর্ণালংকারের ক্ষেত্রে পরিমাণ উল্লেখ না করে বলা হয়েছে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত, মূল্য অজানা। ইলেকট্রনিক সামগ্রী আগে ছিল ৪০ হাজার টাকা, এখনও একই পরিমাণ দেখানো হয়েছে। তবে স্ত্রীর নামে আগে কোনো ইলেকট্রনিক সামগ্রী দেখানো না হলেও এবার ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক সামগ্রী রয়েছে বলে বলা হয়েছে। সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর নিজের নামে থাকা পাঁচ বছর আগে আসবাবপত্রের মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এখনও তাই বলা হয়েছে। তবে স্ত্রীর নামে আগে কোনো আসবাবপত্র দেখানো না হলেও এবার বলা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ফার্নিচার রয়েছে। এছাড়া মান্নান খানের নামে অন্যান্য অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আগে কোনো সম্পদ না থাকার কথা বলা হলেও এবার দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের সম্পদ এবং স্ত্রীর নামে অ্যাপার্টমেন্টের জন্য অগ্রিম ৬০ লাখ টাকা।

স্থাবর সম্পদ : পাঁচ বছর আগে নিজ নামে কোনো কৃষি জমি ছিল না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। স্ত্রীর নামে পৈতৃক সূত্রে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী যৌথভাবে ৩ ভাই ও ৫ বোনের প্রাপ্য জমি ৫ একর। এর থেকে ১ মেয়ের নামে যা আসে। পাঁচ বছর পর এবার পৈতৃক সূত্রে মান্নান খানের পাওয়া কৃষি জমির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫ একর। স্ত্রীর নামে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের কৃষি জমি। যদিও সূত্র জানিয়েছে, স্ত্রীর নামে পিতার বাড়ির এলাকা বগুড়া সদরে প্রচুর জমি কেনা হয়েছে। অকৃষি জমির মধ্যে পাঁচ বছর আগে নিজ নামে দেখানো হয় পাঁচ কাঠা নাল জমি। স্ত্রীর নামে গুলশানে সোয়া ৮ শতক জমি। দাম ৯৫ হাজার টাকা। এছাড়া গুলশানের বেরাইদ মৌজায় ৩১ শতক নাল জমি, মূল্য ৫০ হাজার টাকা। পাঁচ বছর পর নিজের নামে থাকা অকৃষি জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৩১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা এবং স্ত্রীর নামে থাকা জমির মূল্য ১ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। পাঁচ বছর আগে নিজের এবং স্ত্রীর নামে কোনো পাকা দালান ছিল না বলে বলা হয়। এখন সেখানে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক দালানের (নূর আলী টাওয়ারে দুটি ফ্ল্যাট) মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৮১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। অথচ এখানে দুটি ফ্ল্যাটের বাস্তব মূল্য কমপক্ষে ৬ কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগে কোনো মৎস্য খামার ছিল না বলে বলা হলেও এবার বলা হয়েছে পৈতৃক সূত্রে মান্নান খান পেয়েছেন ৫ একর মৎস্য খামার ও স্ত্রীও পৈতৃক সূত্রে ৫ একর মৎস্য খামার পেয়েছেন।

অন্য খবর  দোহারে দাঁতের চিকিৎসায় দুর্দশা: চিকিৎসার নামে প্রতারণা

নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ : নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া সম্পদ বিবরণীর এক স্থানে মান্নান খান লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় জনগণের কাছে দেয়া সব প্রতিশ্র“তি শতভাগ পূরণ করেছেন। এক্ষেত্রে আইন-শৃংখলা, রাস্তাঘাট, নতুন রাস্তা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও নির্মাণ এবং মন্দিরে সহায়তা প্রদানে শতভাগ ওয়াদা রক্ষা করতে পেরেছেন।

যুগান্তর সূত্র জানিয়েছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ব্যাংক এশিয়াতে চাকরি করেন। সেখানে তিনি মাসিক বেতন পান প্রায় ৪২ হাজার টাকা। এছাড়া ছোট ছেলে পড়াশোনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্ত্রী পোলট্রি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি রাজধানীর কলাবাগান লেকসার্কাস রোডে একটি সাধারণ বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। সরকারি বাসায় ওঠার আগে এখান থেকে তিনি কয়েকদিন সচিবালয়ে যাওয়া-আসা করেন। গত পাঁচ বছরে শুধু প্রতিমন্ত্রী ও তার ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের সম্পদের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়েনি, যারা মন্ত্রণালয়ে তার একান্ত সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন তাদেরও নগদ অর্থ ও সম্পদ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

আপনার মতামত দিন