ইতালির বাণিজ্যিক নগরী মিলান শহরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বারুয়াখালী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণখালী গ্রামের যুবক শামসুল হক স্বপনের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয় রবিবার। সকালে তুর্কি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে মিলানোর মালপেনছা বিমানবন্দর থেকে তার লাশ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে আসা হয় নবাবগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে। এসময় পুরো গ্রামজুড়েই শোকের আবহ সৃষ্টি হয়। গ্রামের ভাল ছেলে হিসেবে পরিচিত স্বপনকে একনজর দেখতে শত শত মানুষ বাড়িতে জড়ো হয়। ছেলের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সালমা বেগম ও বাবা আব্দুস সালাম। আর মৃত্যুর খবরের পর থেকে অসুস্থ স্ত্রী আইভি আক্তার কফিনে মোড়ানো স্বামীর লাশ দেখেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
কান্নাজড়িত কন্ঠে স্বপনের মা সালমা বেগম বলেন, ‘গত মাসের ২৬ তারিখে আমার বাবাটার সাথে কথা হইল। বৃষ্টির কারণে কথা বুঝতাছিলাম না। আমার বাবা কইলো, মা কাইল সকালে ফোন দিমু। সকাল বিকাল সন্ধ্যা, এরপর কতদিন কাইটা গেল আমার বাবা তো আর ফোন দিলো না। আমার এহনো মনে হয় এই বুঝি আমার বাবাডা ফোন দিব। ও এভাবে চইলা যাইতে পারে না। তোমরা আমার সোনাটারে আইনা দেও।’
ইতালিতে নিহত স্বপনের বাড়িতে শোকের মাতমস্বপনের বাবা আব্দুল সালাম জানান, পাঁচ ছেলের মধ্যে স্বপনই সবার বড়। সে পরিবারের হাল ধরায় প্রবাস থেকে পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরেছেন তিনি। এখনো খানিকটা ঋণের তলে আছে তার পরিবার। তারপরও একপাশ থেকে আগলে রেখে ছোট ভাইদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন স্বপন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার আগেই এই দূর্ঘটনায় আমাদের সবশেষ হয়ে গেল।
বছরখানেক হয় বিয়ে হয়েছে স্বপন ও আইভির। হাতের মেহেদির রং না শুকাতেই স্বামীর এমন মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছেন না আইভি। রোববার লাশ দেখার পর থেকেই বাকরুদ্ধ তিনি। কোন সান্তনাই তাকে সুস্থ করতে পারছেনা। প্রতিবেশিরা জানান, ২০০৫ সালে এইচএসসি শেষে ঢাকার তেজগাঁও কলেজ পড়ালেখা শুরু করেন স্বপন। পরিবারের কথা চিন্তা করে ২০০৯ সালে প্রথমে ইংল্যান্ড, পরে ইতালিতে প্রত্যাবর্তন করে রেস্টুরেন্টে কাজ করছিলেন। স্থানীভাবে অত্যন্ত স্বজ্জন, মিশুক, পরোপকারি যুবক হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর।
স্বপনের মরদেহ বাড়িতে আসছে এমন সংবাদে সকাল থেকে নিহতের বসতবাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জের বারুয়াখালী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণখালী গ্রামে ভিড় করতে থাকে আত্মীয় স্বজনরা। এছাড়া অনেক অপরিচিত মানুষও স্বপনকে এক নজর দেখতে ছুটে আসে তার বাড়িতে। মা-বাবার চোখের সামনে বসত ঘরের পাশে তৈরি করা হয় কবর। বেলা সাড়ে ১২টায় নিহতের কফিনে মোড়ানো মরদেহ বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলে কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে উঠে বাতাস। হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে এক নজর দেখতে সবার আদরের স্বপনকে। স্বপনের মা-বাবা, স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের কান্না দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি কেউ। জোহরের নামাযের পর নিজ বসতভিটায় জানাযা শেষে চিরদিনের জন্য শায়িত করা হয় স্বপনকে। এসময় সবাইকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায় ‘এমন ছেলে এলাকায় আর হবে না’।
উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল শুক্রবার ইতালির বাণিজ্যিক নগরী মিলান সেন্ট্রাল স্টেশন সংলগ্ন সেত্তেমবিরিনি নামক রাস্তায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বাংলাদেশি যুবক শামসুল হক স্বপন নিহত হন। দীর্ঘ এক মাস পর তুর্কি এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে মিলানোর মালপেনছা বিমান বন্দরে থেকে তার লাশ রোববার সকালে বাংলাদেশ বিমান বন্দরে এসে পৌছায়। এর আগে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৫টায় ইতালির মিলানো ভিয়া পোনছিও মর্গ প্রাঙ্গনে স্বপনের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।