শিক্ষানুরাগী আতা উদ্দিন খান নিভৃতচারী আলোকবর্তিকা

1826

‘দোহার-নবাবগঞ্জের ঘরে ঘরে উচ্চ শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। গৌরবময় জীবনের অধিকারী আতা উদ্দিন খান শিক্ষানুরাগী হিসেবে প্রদীপ্ত হয়ে থাকবেন মানুষের অন্তরে। একটি জনপদে একজন মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ থেকে জাগ্রত কর্মোদ্যমের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। ‘দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ’ প্রতিষ্ঠা আতা উদ্দিন খানের তেমনি এক মহৎ উদ্যোগ।

মহান শিক্ষানুরাগী আতা উদ্দিন খান গত ৩০ নভেম্বর ’১৫ বার্ধক্যজনিত রোগে পরলোকগমন করেন। এই মহান ব্যক্তির প্রয়াণে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের প্রয়াসে লিখতে গিয়ে কলেজের বর্তমান সভাপতি ও স্থানীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি উল্লিখিত এসব কথা বলেন, ‘একজন মানুষের জাগতিক মূল্যায়নের চেয়ে যথার্থ আর কি হতে পারে।’

১৯৬৫ সালের ১ জুলাই নবাবগঞ্জের সমসাবাদ গ্রামে আতা উদ্দিন খান নিজ উদ্যোগে দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত ছিলেন না তিনি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সন্তানের চাইতেও অধিক বাৎসল্যে আগলে রেখেছেন কলেজকে। অসাধারণ বাগ্মী আতা উদ্দিন খান সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্জন করে জ্ঞানের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছেন। অবহেলিত সমাজকে শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করে অর্জিত জ্ঞানের মাধুরী বিকাশে ব্রতী হন। দোহার-নবাবগঞ্জ ও রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেন মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল, চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সি ফার্ম, স্কুল, কলেজসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তিনি শিল্পোদ্যোক্তাও ছিলেন, ইস্টার্ন স্টিল মিলস তাঁরই অবদান। জ্ঞানার্জন ও অর্জিত জ্ঞানের আলো সাধারণ্যে বিলিয়ে দিয়ে পক্ষান্তরে পার্থিব সুখ -শান্তির জন্য আবার উপার্জিত সম্পদ বিনিয়োগ করে সাধারণ্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই তাঁর জীবনদর্শন সাফল্যে উদ্ভাসিত।

রাজধানী ঢাকার অতি সন্নিকটে হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দোহার-নবাবগঞ্জবাসী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বরাবরই পিছিয়ে ছিল। এর অন্যতম কারণ ১৯৬৫ সালের পূর্বে এতদাঞ্চলে কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। মুষ্টিমেয় বিত্তবানদের সন্তান-সন্ততিরাই কেবল ঢাকা বা কলকাতায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন দেখার সাহস করত। আর নারীদের উচ্চশিক্ষা কল্পনাই করা যেত না সে সময়। এর বাইরে অল্পসংখ্যক মেধাবী ও উচ্চাকাক্সক্ষী যুবক নিজেদের চেষ্টায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে। আতা উদ্দিন খান সেসব মেধাবী তরুণদের একজন যিনি দারিদ্র্যের কাছে হার মানেননি। তিনি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে লন্ডন থেকে ১৯৫৮ সালে এফসিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে চতুর্থতম ব্যক্তি হিসেবে তিনি এফসিএ ডিগ্রি অর্জনের গৌরব লাভ করেন।

অন্য খবর  গালিমপুর মাজারে নিয়মিত যাচ্ছেন আরফিন রুমী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয় তার কর্মজীবন। শুরু থেকেই বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী আতা উদ্দিন খানের জীবন। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পাঠ নেন। একই বছর ১ জুলাই থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৯ সালে সাংসদ হয়ে তিনি প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং পরে শ্রম ও জনশক্তিমন্ত্রী হিসেবে দেশ গঠনে অবদান রাখেন।

শ্রম ও জনশক্তিমন্ত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সৌদী আরব, ইরাক, বাহরাইন, আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশে চাকরির উদ্দেশ্যে জনশক্তি পাঠাতে সক্ষম হন। জনশক্তি রপ্তানির সূচনা হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবন মান উন্নততর হতে শুরু করে। শুধু অর্থ উপার্জন বা আর্থিক উন্নতিই একটি সদ্য স্বাধীন দেশের সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি নয়। জনসাধারণকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে তা খুব দ্রুততর করা সম্ভব। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি স্বাধীনতা-পূর্ব তার প্রতিষ্ঠিত দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের প্রতি বিশেষ নজর দেন। পাশাপাশি নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।

এর পর্যায়ক্রমে তিনি যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তার মধ্যে নবাবগঞ্জ এতিমখানা ও মাদরাসা, নবাবগঞ্জ কেন্দ ীয় জামে মসজিদ, খানহাটি জামে মসজিদ, ছাতিয়া বড়বাড়ি জামে মসজিদ, চরচরিয়া জামে মসজিদ, খানেপুর জামে মসজিদ, ইছামতি কলেজ, গালিমপুর সোনাভান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বাগমারা উচ্চ বিদ্যালয়, খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয়, গোল্লা সেন্টথেকলাস উচ্চ বিদ্যালয়, হাসনাবাদ সেন্ট ইউফ্রেজিজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, তুইতাল মিশনারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, জয়পাড়া বেগম আয়েশা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি অ্যান্ড গার্লস হাই স্কুল উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত ‘আতা খান অ্যান্ড কোম্পানি’ দেশের অন্যতম চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্সি ফার্ম। রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় আতা খান জেনারেল হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য এক প্রতিষ্ঠান। সুখী, সমৃদ্ধ ও আলোকিত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে জীবনের প্রতিটি স্তরে আতা উদ্দিন খান নিরবে নিভৃতে বিচরণ করেছেন।

অন্য খবর  ভাঙ্গছে দোহারের মৈনট ঘাট

দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং আজীবন কলেজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে উন্নয়নে অবদান রেখেছেন আতা উদ্দিন খান।

একটি নিবন্ধে কয়েক শব্দ লিখে প্রকাশ সম্ভব নয় একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিকাশের ইতিবৃত্ত। শত বাধাবিপত্তি সমালোচনা কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে। শিক্ষানুরাগী হিসেবে এলাকার প্রতিটি ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। নিজ অর্থায়নে জমি কিনে ছোট্ট টিনের চালাঘরে যাত্রা শুরু হয় কলেজটির। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতাসহ কলেজের সকল ব্যয় তিনি বহন করেছেন। মন্ত্রী হয়ে কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করেন। গড়ে তোলেন তিনটি বহুতল একাডেমিক ভবন। তিনতলা প্রশাসনিক ভবন, কলেজ আঙিনার দ্বিতল মসজিদ ও দ্বিতল ছাত্র কমনরুম সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়। কলেজ আঙিনার দক্ষিণ দিকে একটি একাডেমিক ভবনের পাঁচতলা ভিত্তিসহ প্রথম ও দ্বিতীয় তলার কাজ তার অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। কলেজের কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বড়তে থাকে। এলাকার উদ্যমী যুবক ও সমাজ হিতৈষীদের সাথে নিয়ে কলাকোপা কলেজ ছাত্রাবাস ও কলেজের পূর্ব দিকে খেলার মাঠ সম্প্রসারণ করেন। শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে নিজ অর্থায়নে কলেজ মাঠের উত্তরদিকে নির্মাণ করেছেন ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ছাত্রাবাস। দূরদর্শী শিক্ষানুরাগী আতা উদ্দিন খান প্রতি শিক্ষাবর্ষে কলেজের কয়েকজন মেধাবী ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার সকল খরচ বহন করেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলি হযরত শাহ্ সুফি মো. ইসমাইল ক্বারী (র.) ও হযরত আফাজ উদ্দিন শাহ (র.)-এর স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি নবাবগঞ্জ। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল মহাকবি কায়কোবাদের অমর সাহিত্য গাথায় মিশে আছে জন্মভূমি নবাবগঞ্জের মাটি ও মানুষের মহিমা।

অবিভক্ত ভারতের যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াছেক মিয়া এই নবাবগঞ্জেরই সন্তান। সেইসব মনীষীদের অনন্য উচ্চতায় শিক্ষানুরাগী আতা উদ্দিন খান সমাসীন। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে তাঁর অনন্য অবদান চিরস্মরণীয়।

আপনার মতামত দিন