ঝিনাইদহের মাহফুজ। সৌদি গেছেন সাড়ে ৬ মাস আগে। ‘আমেলে মনজিল’ নামে একটি ভিসা দিয়ে তাকে ওই দেশে পাঠানো হয়েছে। এ ভিসার পরিধি হচ্ছে, নির্দিষ্ট মালিকের অধীনে বাসাবাড়ির কাজ। কিন্তু তিনি যে মালিকের অধীনে কাজে গেছেন আজ পর্যন্ত সেই মালিকেরই দেখা পাননি। যারা তাকে নিয়ে গেছে তারাও মালিকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেননি। তবে সংশ্লিষ্ট সৌদি মালিক জানেন তার বাসায় কাজ করতে একজন বাংলাদেশি এসেছেন। কিন্তু ওই জানা পর্যন্তই শেষ। তিনি তাকে কাজে নিতে চান না। অজুহাত দেখান, তার কাজের লোকের দরকার নেই। তাই বেতনও দিতে পারবেন না। উল্টো আকামা করে দেয়া বাবদ প্রতিবছর তাকে একটি নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হবে। এই টাকার পরিমাণ ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার পর্যন্ত। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তাকে অন্য কোথাও কাজ ম্যানেজ করতে হচ্ছে। যদিও বাসাবাড়ির বাইরে এ ভিসায় অন্য কোথাও কাজ করার সুযোগ নেই। এদিকে কয়েক জায়গায় কাজ জুটালেও বেতন মেলেনি মাহফুজের। ফলে এক দুুর্বিষহ সময় পার করছেন তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদে তাই মাঝেমধ্যে দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিতে হয়। শুধু মাহফুজ নয়, এমন অবস্থা সৌদি আরবে কাজের সন্ধানে যাওয়া হাজার হাজার বাংলাদেশির।
মাহফুজ জানান, সাড়ে ৬ মাস আগে রাতুল ট্রেডিং ওভারসিজ নামে একটি রিক্রটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব গেছেন। তাকে পাঠানো হয়েছে দেশটির নাজরানা এলাকায়। একই কোম্পানির মাধ্যমে তারা একসঙ্গে গেছেন ২০০ জন। যাদের বেশিরভাগই গেছেন ‘আমেলে মনজিল’ ভিসায়। তার ভাষ্যমতে তাদের সকলের ভাগ্যেই একই ঘটনা ঘটেছে। এ ভিসায় গিয়ে কাজ না পাওয়া বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মী জানান, নির্দিষ্ট এই ভিসার কারণে বাসাবাড়ির বাইরে তাদের কাজ করার সুযোগ নেই। ফলে তাদেরকে অন্য কোথাও কাজ করতে দেখলে পুলিশ ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে আসায় কষ্ট হলেও পালিয়ে বেড়ায়। পুলিশের কাছে ধরা দিতে চায় না। তারা আরো জানায়, এই ভিসায় তাদের যে এলাকায় পাঠানো হয়, সে এলাকার বাইরে গিয়ে নিজ ইচ্ছায় কাজ করারও সুযোগ নেই। কেবল সংশ্লিষ্ট মালিক অনুমতি দিলেই যেতে পারেন। তবে মালিকরা এমন অনুমতি দেন না। এছাড়া ফ্রি ভিসার নামে গিয়েও হাজার হাজার কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তারা আরো বলেন, ‘আমেলে মনজিল’ ভিসায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট মালিকের বাসায় কাজ তো পাওয়াই যায় না, উল্টো প্রতিবছর তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হবে। তাদের দাবি, এই ভিসায় আসা ৩-৪ লাখ বাংলাদেশি কাজ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তবে তাদের এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি। কর্মহীন বাংলাদেশিরা বলেন, ‘আমেলে মনজিল’ ভিসায় এসে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ কাজ পায় না। মাহফুজ বলেন, তিনি যে এলাকায় আছেন, সে এলাকায় ৩০০-৪০০ লোক বেকার। কাজ না থাকায় কয়েকবার বাড়ি থেকে টাকা এনেও বাসাভাড়া এবং খাওয়া খরচ চালিয়েছেন। বর্তমানে লুকিয়ে নাজরানা থেকে রিয়াদে গিয়ে একটি কোম্পানিতে গোপনে কাজ শুরু করেছেন। তবে বেতন পাবেন কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। তার ভাষ্য, আগে থেকে যারা কাজ করতো তাদেরও অনেকেই ইতিমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার কানাইনগর গ্রামের আলমগীর হোসেনও ৬ মাস আগে কাজ নিয়ে গেছেন রিয়াদের মেসার্স মাযায়া আল দোহা কনস্ট্রাকশন নামে একটি কোম্পানিতে। এরপর কোম্পানি তাকে জেদ্দার সাফারি ক্যাম্পে পাঠায়। সেখানে ৫ মাস কাজ করার পরও বেতন দেয়নি। এমনকি খাওয়াও দিতো না ঠিকমতো। একপর্যায়ে পালিয়ে তার এলাকার এক প্রবাসীর কাছে গিয়ে ওঠেন। ওই প্রবাসী তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। আলমগীর জানান, কোনো কাজ নেই। কিন্তু দেশেও ফিরতে পারছি না। কারণ যে ৬ লাখ টাকা খরচ করে এসেছি তার পুরোটাই ঋণের। এখন যদি বাড়ি যাই, তাহলে তার ওপর চাপ আরো বাড়বে। কিভাবে চলছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে বালতি হাতে করে রাস্তায় দাঁড়ায়। যদি একটি গাড়ি ধুতে পারি তাহলে কিছু আয় হয়। কিন্তু সবদিন হয়ও না। ফলে কোনোরকম চলছি। তার মতো শত শত বাংলাদেশির একই অবস্থা বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে রিয়াদে মেসার্স মাযায়া আল দোহা কোম্পানির সোলায় ক্যাম্পে থাকা একজন বাংলাদেশি জানান, বর্তমানে সেখানে ৩ শতাধিক বাংলাদেশি কাজ না পেয়ে ক্যাম্পে বেকার দিন কাটাচ্ছে। তাদেরকে এক বেলা খাবার দেয়া হচ্ছে। এর আগে গত ২৭শে জুলাই রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল (শ্রম উইং) জানান, রিয়াদের মেসার্স মাযায়া আল দোহা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির পাঠানো ১৮২ জন কর্মী জেদ্দার আল-সাফারি ক্যাম্প, মোহাত্তা রহমানিয়ার নিকটবর্তী এলাকায় ইকামা ও কর্মহীন জীবনযাপন করছে। ওই চিঠিতে জানানো হয়, গত সাড়ে চার মাস আগে তারা সৌদি আরবে আসেন। দেড়মাস রিয়াদে কর্ম ও বেতনবিহীন অবস্থানের পর তাদেরকে জেদ্দাস্থ একটি কোম্পানিতে কাজ দেয়া হয়। কিছুদিন কাজ করার পর আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে তাদের কাজের কোনো ব্যবস্থা নেই। সৌদি আরব আগমনের পর থেকে এ পর্যন্ত তারা কোনো বেতন পাননি। চিঠিতে আরো বলা হয়, এইসব কর্মীরা বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আল বশির লিমিটেড, মেসার্স সেন্ডার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ইস্টল্যান্ড নেটওয়ার্ক, মেসার্স জাহরাত এসোসিয়েটস সহ আরো কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব গমন করেন। এদিকে সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, দেশটিতে ফ্রি ভিসার নামে যারা গেছেন, তাদের প্রায় সবাই বেকার অবস্থায় দিন পার করছেন। এছাড়া আর্থিক মন্দার কারণে বিভিন্ন কোম্পানি থেকেও তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এদিকে কর্মহীন কর্মীদের বেশ কয়েকজন জানান, বাংলাদেশের গ্যালাক্সি ট্রাভেলস্, আমান এন্টারপ্রাইজ, আইডিএল এন্টারপ্রাইজ, জাহার এন্টারপ্রাইজ সহ বেশকিছু রিক্রুটিং এজেন্সি সম্প্রতি যেসব কর্মী পাঠিয়েছেন তাদের অনেকেই বেকার জীবনযাপন করছেন। অনেকে সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আজহারুল হক বলেন, ফ্রি ভিসার কারণে সেখানে বেকার বাংলাদেশির সংখ্যা বেড়েছে। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে ফ্রি ভিসা নামে কোনো ভিসা নেই। ফ্রি ভিসার নামে যে ভিসা দেয়া হয় তাতে নির্দিষ্ট কোনো ক্ষেত্র বা কোম্পানিতে কাজের উল্লেখ থাকে না। ফলে অনেকে এ বিষয়টি না বুঝে সেদেশে গিয়ে বিপাকে পড়েন। এজন্য আমরা ক্যাম্পেইন করছি। কেউ ডিমান্ড আনলে সেটা সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্য দূতাবাসের দ্বারা সত্যয়ন করার প্রক্রিয়াও চালু করা হয়েছে। এতে করে জানা যাবে, যেখানে কর্মী পাঠানো হচ্ছে সেখানে আদৌ কাজ আছে কিনা।