মারাকানায় কোপা আমেরিকার শিরোপা আগেই জেতা ছিল ব্রাজিলের। কিন্তু ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল পেরু, শক্তি আর ইতিহাসে যারা ব্রাজিলের চেয়ে যোজন পিছিয়ে। ঘুরে ফিরে তাই মারাকানার কুখ্যাত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হওয়াটাই ব্রাজিলের একমাত্র চাওয়া ছিল। সেটা হয়নি, ব্রাজিল শেষ পর্যন্ত পেরুকে পেরিয়ে নবম কোপা আমেরিকা শিরোপা জিতে নিয়েছে। ৩-১ স্কোরলাইন অবশ্য অন্য কথা বলতে পারে। তবে ৮৯ মিনিটে রিচার্লিসনের পেনাল্টি থেকে জয় নিশ্চিত হওয়ার আগে মারকানায় গল্প জমিয়ে ফেলেছিল ব্রাজিল-পেরু। ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে থাকার পর শেষ ২০ মিনিট ব্রাজিল খেলেছে একজন কম নিয়ে। গ্যাব্রিয়েল হেসুস অ্যাসিস্ট করেছেন, গোল করেছেন এরপর তিনি লাল কার্ডও দেখেছেন। তবে নিজেদের মাঠে গল্পটা এবার আর অন্য কারও হতে দেয়নি সেলেসাওরা। তিতের ব্রাজিল ঘরের মাঠে শিরোপার সঙ্গে জিতে নিয়েছে ব্রাজিলিয়ানদের ভালোবাসাও।

হলুদ মারাকানা তাই ম্যাচশেষেও হলুদই ছিল, ভরা মাঠে সমর্থকদের সামনে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছেন দানি আলভেজ। এক যুগ আগে ব্রাজিল যখন সবশেষ দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল, সে দলেও ছিলেন তিনি। একমাত্র  তারই ছিল কোপা জেতার অভিজ্ঞতা। ৩৬ বছর বয়সে অধিনায়ক হিসেবে আলভেজ শিরোপা এবার সবার আগে, দলের হয়ে, ব্রাজিলের হয়ে। মারাকানায় রুপালি কনফেত্তিতে ছাওয়া আকাশে  এরপর শোনা গেছে শুধু ‘চাম্পিওনে, চাম্পিওনে’ রব।

মারাকানায় বিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না শুরু থেকেই। ব্রাজিল কিছুটা ধীর গতিতে ম্যাচ শুরু করেছিল। কিন্তু এগিয়ে যেতে সময় লাগেনি তাদের।  ১৫ মিনিটে গ্রেমিও স্ট্রাইকার এভারটনের গোলে লিড নেয় ব্রাজিল। অধিনায়ক আলভেজও তাতে রেখেছেন বড় ভূমিকা। নিজের অর্ধ থেকে রাইট উইংয়ে লং বল পাঠিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল হেসুসকে। তিনি দারুণ এক টার্ন নিয়ে নিখুঁত ক্রস করেছিলেন ফারপোস্টে। গোলের সামনে ব্রাজিলের দুইজন খেলোয়াড়কে পাহারা দিতে ব্যস্ত ছিলেন পেরুর তিন ডিফেন্ডার। ফাঁকায় ছিলেন এভারটন। বল আর মাটিতে পড়তে দেননি তিনি, ডান পায়ের নিচু ভলিতে গোল করে ব্রাজিলিয়ানদের সাম্বার ছন্দ তুলে দিয়ে দিয়েছিলেন ২৩ বছর বয়সী।

সেই ছন্দ ব্রাজিল আর হারায়নি। তবে ৪১ মিনিটে নিজেরাই পেনাল্টি দিয়ে পেরুকে সমতায় ফেরাতে সাহায্য করেছিল ব্রাজিল। ডানদিক থেকে দারুণ এক আক্রমণে পেরুর ফ্লোরেস ও কুয়েভা ওয়ান টু করে ঢুকে পড়েছিলেন বক্সের ভেতর। কুয়েভার এরপর করতে চেয়েছিলেন মাইনাস, তবে ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা বল ক্লিয়ার করতে চেয়েছিলেন। হাত ছিল বাইরে, তার হাতেই লাগল বল। রেফারিও সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন। পেরুর ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা পাওলো গেরেরো অ্যালিসনকে ভুল দিকে পাঠিয়ে গোল করেন স্পটকিক থেকে। ব্রাজিল যখন এগিয়ে থেকে বিরতিতে যাবে ভাবছিল তখনই গোলমাল পাকিয়ে বসে পেনাল্টিটা। টুর্নামেন্টে ৫ ম্যাচ পর ওই প্রথম গোল হজম করলেন অ্যালিসন। সেটাই যে শেষ, তখনও অবশ্য তা জানা ছিল না।

অন্য খবর  দেশের ফুটবলভক্তদের জন্য ৩০টি বিশেষ ফ্লাইট চালু করছে মরক্কো

এভারটনের গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরও দুইটি ভালো গোলের সুযোগ পেয়েছিল ব্রাজিল। একবার ফিলিপ কুতিনিয়ো বক্সের ভেতর থেকে মেরেছেন বাইরে দিয়ে উড়িয়ে, আরেকবার রবার্তো ফিরমিনো ফারপোস্ট থেকে সহজ হেড রাখতে পারেননি লক্ষ্যে। তাই পেরুর পেনাল্টিটা আফসোসও বাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রাজিলের। কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের আক্ষেপ আর বাড়াতে দেননি হেসুস। প্রথমার্ধে ইনজুরি সময়ের শেষ মিনিটে মিডফিল্ডে দারুণ এক ট্যাকেল করে পেরুর কাছ থেকে বল কেড়ে নেন ফিরমিনো। সেখান থেকে আর্থার বল নিয়ে ডিবক্সের ঠিক সামনে থাকা হেসুসকে পাস বাড়ান। হেসুস দুই তিনজন ডিফেন্ডারকে সামনে রেখে সামনে এগিয়ে দারুণ কম্পোজারে বটম লেফট কর্নারে বল জড়িয়ে আবারও স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন মারাকানায়। ২-১ গোলে এগিয় থেকে বিরতিতে যায় ব্রাজিল।

বিরতির পর ৫৩ আর ৫৬ মিনিটে ফিরমিনোর কাছে দুইটি হাফ চান্স গিয়েছিল। তবে একবারও কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। একবার হেড করেছেন বাইরে দিয়ে, আরেকবার শট। দ্বিতীয়ার্ধের পনেরো মিনিট পেরুকে বেশ চাপেই রেখেছিল ব্রাজিল। তিতের দলের বেশিরভাগ আক্রমণের মূল উৎস ছিলেন হেসুস আর এভারটন। দুইজনই দুই প্রান্তে দুই ফুলব্যাকের কাছ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পাচ্ছিলেন। এরপরও ৬০ মিনিটের পর পেরু ম্যাচে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা চালালে কিছুটা চাপেই পড়ে যায় ব্রাজিল।

রিকার্ড গারেচার পেরু ফাইনালে উঠেছিল ৪৪ বছর পর। গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের কাছে ৫-০ গোলে হারের পর পেরুর আর্জেন্টাইন কোচের কয়েকটি সিদ্ধান্ত রাতারাতি বদলে দিয়েছিল দলকে। চিলির বিপক্ষেও দারুণ ছিল তারা। ফাইনালে যে যোগ্য দল হিসেবেই উঠেছে পেরু, তাদের খেলায় সেই ছাপও থাকল মিশে। প্রায় মিনিট দশেক ব্রাজিলকে তাদের অর্ধেই ব্যস্ত রাখল পেরু। সেই চাপে গোল না পেলেও ব্রাজিলের একজন কমে যাওয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখেছিল পেরু। ঘটনা ৭০ মিনিটে, কিছুক্ষণ আগেই হেসুস আর আন্দ্রে কারিয়ারোর শক্তি পরীক্ষা হয়েছিল একটি বল দখলের সময়। তখন হেসুস হয়েছিলেন ফাউলের শিকার। এবার হেসুস মেরে বসলেন কারিয়োকে। রেফারি ৩০ মিনিটে একবার হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করেছিলেন তাকে, পরের বার হেসুস তাই দেখলেন দ্বিতীয় হলুদ কার্ড।

রাগে ক্ষোভে মাঠ ছাড়ার সময় ভিএআরের জন্য রাখা টিভিতে ধাক্কা মেরে গেছেন হেসুস। যদিও ভিএআর এক্ষেত্রে নিরুপায়ই ছিল। দ্বিতীয় হলুদ কার্ড রিভিউ করার নিয়ম নেই এতে। হেসুস পরে মারাকানার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসে কেঁদেছেন কিছুক্ষণ।

হেসুসের ওই কান্না অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ম্যাচের বাকি ২০ মিনিট দশ জন নিয়ে খেলেও ব্রাজিলকে টলাতে পারেনি পেরু। তিতে ফিরমিনোকে তুলে নামিয়েছিলেন রিচার্লিসনকে। আর কুতিনিয়োকে বিসর্জন দিয়েছিলেন আরেকজন ডিফেন্ডার বাড়াতে। তার জায়গায় নেমেছিলেন এডার মিলিতাও।

অন্য খবর  কলম্বিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে ব্রাজিল

ঘরের মাঠে সমর্থকদের চাপে ভেঙে পড়ার অভ্যাস ব্রাজিলের নতুন কিছু নয়। এবারও প্রায় তেমন কিছুর শঙ্কা জেগেছিল। কিন্তু ব্রাজিলকে শেষদিকে আর স্নায়ুচাপে আর ভুগতে দেননি এভারটন। পুরো ম্যাচে গতি আর ড্রিবলিং দিয়ে পেরু ডিফেন্ডারদের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলেন তিনি। ৮৭ মিনিটেও যে অমন কিছু জমা ছিল তার ঝুলিতে তা কে জানত? আর যাই হোক, পেরু খেলোয়াড়রা জানতেন না নিশ্চিতভাবেই। বিদ্যুৎ গতিতে ডানদিক থেকে কাট করে ভেতরে ঢুকে গেলেন, এরপর ডিবক্স বরাবর সোজা দৌড়ে যাচ্ছিলেন বলের নাগাল পেতে। পেরু ডিফেন্ডার জামব্রোনার ধাক্কা খেয়ে এরপর পড়ে গেলেন বক্সের ভেতর। আরও একবার চিলিয়ান রেফারি রবার্তো তোবারের পেনাল্টির সিদ্ধান্ত। আগের বারের মতো এবারও মাঠের বাইরে গিয়ে আরেকবার নিজের সিদ্ধান্ত যাচাই করে আর সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো না তোবারকে। রিচার্লিসন স্পট কিক থেকে গোল করতেই জার্সি খোলা উদযাপন তার, সঙ্গে যোগ দিল পুরো দল। মারাকানাও ততোক্ষণে জেনে গেছে গল্পের সুন্দর সমাপ্তিই হতে যাচ্ছে।

এই পেরুর কাছে হেরেই গতবার কোপা আমেরিকা সেন্টানারিওর গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল ব্রাজিল। এরপর দলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিতেকে। গত বিশ্বকাপে আশা পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু ব্রাজিলও তার ওপর থেকে ভরসা হারায়নি। তিতে শেষ পর্যন্ত প্রতিদান দিয়েছেন বিশ্বাসের। ব্রাজিলকে আরও একবার করেছেন দক্ষিণ আমেরিকার সেরা! আর পেরুর কাছে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হয়ে গেছে এতো কাছে তবু এতো দূরের মতো।

চ্যাম্পিয়ন বাদে অন্যকিছু এবারও হয়ত মেনে নিতেন না ব্রাজিলিয়ানরা। আগের চারবার আয়োজক হওয়ার পর প্রতিবারই শিরোপা জিতেছে তারা। আর গত চার বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পর কোপার শিরোপা উঁচিয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষা আরও প্রবল হয়েছিল ব্রাজিলে। এই টুর্নামেন্ট শুরু আগে তাই চাপে ছিলেন তিতে, চাপে ছিল ব্রাজিলও। গ্রুপপর্বে দুই ম্যাচে দুয়ো শুনে মাঠ ছেড়েছিল তার দল। তিতে আশা হারাননি। সমালোচনাকে বরং স্বাগত জানিয়েছেন। এরপর ধীরে ধীরে টুর্নামেন্টে উন্নতি করেছে ব্রাজিল। সেমিফাইনালে চিরপ্রতিদ্বিন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর শিরোপায় এক হাত দিয়েই রেখেছিলেন তিতে, আজ দুই হাতে তুললেন কোপার ট্রফিটা। এরপরের লক্ষ্য কি? নিশ্চয়ই বিশ্বকাপ।

ব্রাজিলঃ অ্যালিসন; আলভেস, সিলভা, মার্কিনহোস, সান্দ্রো; কাসেমিরো, আর্থার; হেসুস, কুতিনিয়ো, এভারটন; ফিরমিনো

পেরুঃ গালিসি; আদভিঙ্কুলা, জাম্ব্রানো, আব্রাম, ট্রাউকো; ইয়োতুন, তাপিয়া; ফ্লোরেস, কুয়েভা, কারিও; গুরেরো

আপনার মতামত দিন