দোহার নবাবগঞ্জে আশংকাজনক হারে বাড়ছে নিষিদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম। ২০১৬ সালে শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের অঙ্গিকার থাকলেও দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় এ কাজের নেই কোনো অগ্রগতি বা তৎপরতা । সরকারী ভাবে নেই কোনো সচেতনতা মূলক কার্যক্রম। সরকার দেশকে স্বয়ং সম্পূর্ণ ও উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেও এ দুই জনপদের অনেক দরিদ্র শিশুরা এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রয়েছে। অভাবের তাড়নায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও তাদের ভাগ্যে জুটছে নামমাত্র মজুরি। শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, পরিবারের অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতা ও বেকারত্ব।
এ দুই উপজেলায় বসবাসের জন্য আসা শিশুরা এবং বিভিন্ন গ্রামের নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুরা স্কুল ব্যাগের পরিবর্তে বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন পেশা। সরকার যেখানে প্রতিবছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩৩ কোটি বই শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে বিতরণের মাধ্যমে বই উৎসব পালন করছে। সেখানে দোহার নবাবগঞ্জের কিছু শিশুরা দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগার করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। গত পনের দিনের অনুসন্ধানে দোহার নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা মিলেছে অনেক কোমলমতী শিশু শ্রমিকের। এদের বেশিরভাগই কাজ করছে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরা, চায়ের দোকান, ইটভাটা, ওয়েলডিং কারখানা, ওয়ার্কশপ ও রিকশা ভ্যান চালানোর মতো বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণসব পেশায় । দোহারের লটাখোলা নতুন বাজার,বাংলা বাজার,বিলাসপুর বাজার,পালামগঞ্জ বাজার,নারিশা বাজার নবাবগঞ্জের খানেপুর বাজার,বারুয়াখালী বাজার,শোল্লা বাজার,গালিমপুর বাজার, দূর্গাপুর বাজারসহ কার্তিকপুর, মৈনট, মেঘুলা, নারিশা, ফুলতলা ও নারিশা পল্লিবাজারের হোটেল গুলোতে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করছে দশ থেকে ১২ বছরের শিশুরা। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা বই খাতা সেই বয়সে অভাবের সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সরেজমিনে গিয়ে দোহারের মুকসুদপুর ইউনিয়নের পল্লীবাজারের জামাই হোটেলে গিয়ে দেখা যায় সোহেল নামে ১০ বছর বয়সী একটি শিশু দুই বছর ধরে প্লেট ধোঁয়ার কাজ কাজ করছে। এছাড়া নারিশা বাজারে সাগর হোটেলে মনির (১১), মেঘুলা বাজারে সুমন (১২), জয়পাড়া ভাই বোন হোটেলে উজ্জল (১১), কার্তিকপুর সোমা হোটেলে করিম (১০) ও মৈনট ঘাটে রিমা হোটেলে আলী (১১) নামে শিশুরা কাজ করছে। এক হোটেল মালিকে সাথে কথা বললে তিনি জানায়, শিশুদের মাসিক ১৮ শত থেকে দুই হাজার টাকা বেতন দিলে ভোর থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত কাজ করানো যায়।
![](https://news39.net/wp-content/uploads/2024/06/rashed-chokder-adha24-min.jpg)
দোহারের মুকসদপুর ইউনিয়নের ফুলতলা বাজারের রিকশাচালক আলামিন। সবেমাত্র এগারোতে বছরে পা দেওয়া শিশুটি সারাদিন রিকশা চালায় ফুলতলা-বালাশুড়-শ্রীনগরের বিভিন্ন রোডে। কেন এত অল্প বয়সে এই পেশায় এসেছো জানতে চাইলে আলামিন বলে,” বাপ নাইক্য,বাড়িতে মা আর ছুটু ছুটু দুই বইন, রিকশা না চালাইলে খামু কি ? সারাদিন যে টেক্যা পাই তা দিয়েই সংসার চালান লাগে”।
নবাবগঞ্জের চা বিক্রেতা সুমনরে সঙ্গে কথা বলে জানা যায় সে নবাবগঞ্জে এসেছে জীবিকার তাদিগে। সুমন বলেন,”আমরা গরীব মানুষ লেখাপড়া করানের টেক্যা নাই তাই আব্বায় চা কফি বেচপার পাঠাইছে। আব্বায় রিকশা চালায় আর মায়ে মাইনষের বাড়িতে কাম করে। সবাই মিলা যে টেক্যা পাই তা দিয়্যেই আমাগো সংসার চলে”।
এছাড়াও নবাবগঞ্জের সাহেবগঞ্জ এলাকার ইটভাটায় কাজ করছে আট বছর বয়সী পলাশ। প্রতিদিন এক হাজার ইট বহনের কাজ করে সে মজুরি পায় মাত্র ১০০ টাকা। শুধু পলাশ নয়, পেটের দায়ে প্রতিদিন তার মতো অন্তত কয়েকশত শিশু দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করছে। অথচ আইন অনুযায়ী ১২ বছরের কম বয়সের শিশুদের এ রকম কাজে নেওয়া নিষিদ্ধ। দোহার উপজেলার ইসলামপুর ইটভাটায় কাজ করে ৬ বছর শিশু মিরাজ। পেটের দায়ে বরিশাল থেকে মায়ের সঙ্গে এসেছে সে ইটের ভাটায় কাজ করতে। মিরাজ জানাল, এই ভাটার মালিক তাদের বাড়িতে গিয়ে তার মাকে ৩০ হাজার টাকা দাদন দিয়েছেন। দাদনের টাকা শোধ করতেই সে মায়ের সঙ্গে কাজ করতে চলে এসেছে। তার একটাই কথা ‘কাম না করলে খামু কি?’
দোহার-নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি ইটের ভাটা। সেসব ভাটায় কাজ করছে মিরাজ অথবা পলাশের মতো আরো অনেক মেয়ে ও ছেলে শিশু। শিশু শ্রমিকদের বিষয়ে জানতে চাইলে ইটভাটা মালিকেরা বলেন, বাবা-মায়ের সঙ্গেই এসব শিশু ভাটায় কাজ করতে আসে। তবে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা মজুরি নিয়েই সেখানে কাজ করছে। মিরাজ আরও জানাল, মাথায় করে শুকনো ইট খোলায় তুলে সে। পোড়া শেষ হলে ইট সাজিয়ে রাখে। কাজ বড় কষ্টের। অনেক সময়ে ইট মাথা থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পায়। কিন্তু শ্রমিক সরদার এগুলো দেখে না। একই রকম কষ্টের কথা জানায় নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ এলাকায় ইটভাটার এগার বছরের শ্রমিক শান্ত। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। সেও মায়ের সঙ্গে ইটভাটায় কাজ করতে এসেছে।
জানা যায়, দোহার ও নবাবগঞ্জের ইটভাটাগুলোয় কর্মরত শিশুদের বেশিরভাগই এসেছে কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, সাতক্ষীরা, সিলেট, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর থেকে। তাদের অভিভাবকদের অনেককে ভাটা-মালিকরা দাদন দিয়েছেন। এই টাকা পরিশোধ করতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের শিশু সন্তানরাও কাজ করছে। কাজ শেষে এসব শিশু ভাটাতেই ঘুমায়। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় তাদের কাজ। মাঝে কিছু সময় বিরতির পর টানা কাজ করে বিকাল চারটা পর্যন্ত। নবাবগঞ্জের সাহেবগঞ্জ এলাকার ন্যাশনাল ব্রিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক নাসির উদ্দিন পান্নু জানান, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানরাও ইটভাটায় আসে। তার ভাটায় শিশুদের দিয়ে কোনো কাজ করানো হয় না। তবে ওরা মাঝে-মাঝে ইট নিয়ে খেলে থাকে।
শিশুশ্রম বিষয়ে জানতে চাইলে নবাবগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহনাজ মিথুন মুন্নী জানান, “শিশুদের কাজ করানোর বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।
এ বিষয়ে দোহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে.এম. আল-আমীন বলেন, “বিষয়টি তার জানা ছিল না। দ্রুতই খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে”।
![](https://news39.net/wp-content/uploads/2023/08/protiva-coaching-ad-primary-teacher-2023-min.jpg)