আজ হঠাৎ খুব মনে পড়ছে আমার প্রিয় দোহারের কথা। এই জনপদ তো থাকবার কথা চির উৎফুল্ল; যেখানে ধানক্ষেতের আইল ধরে চলবে কৃষকের দল, পদ্মায় পাল তুলে ছুটে চলবে জেলেদের নৌকা, আমার ভাইবোনেরা ব্যস্ত হয়ে পড়বে প্রতিটা সকালে স্কুল-কলেজের উদ্দেশে। হঠাৎ কী এক প্রলয়ঙ্কারী রোগ এসে জেঁকে বসলো কালো মেঘ হয়ে প্রিয় নীলচে আকাশে। আমাদের জীবনের চেয়ে প্রিয় দোহারের বুকটা ছেয়ে ফেললো বিষন্নতায়। দেখতে দেখতে দোহারে আজ তেরই জুন পর্যন্ত এই কোভিড নাইনটিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলো ১৫৭ জন। এর শেষ কোথায় গিয়ে হবে তা অজানা। সংখ্যাটা কতোর কোটায় গিয়ে ঠেকবার সম্ভাবণা আছে তা একটু ভেবে দেখতে গিয়ে বুকটা শিউরে উঠলো। সংক্রমণ প্রতিদিন যেভাবে বাড়ছে তার থেকে রেহাই কে পাবে বলা মুশকিল।
আমার মা, বাবা, পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। চিন্তিত আমার মতো সবাই, যারা প্রবাসে থাকেন। প্রিয় মাতৃভূমিকে ছেড়ে পরের দেশে দিনের পর দিন যাদের জন্য কাটাই, তারাই যখন এমন বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে, আমাদের আর্তনাদের পাল্লাটা বড় ভারী হয়ে যায় তখন। গত দু’দিন আগেও মার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। অস্ফুট স্বরে মা বলছিলো “আমাগো নিয়া চিন্তা কইরো না, তুমি সাবধানে থাইকো বাজান”। আমার গলা আঁটকে যাচ্ছিলো। জোয়ারের মতো চোখ ভরে আসছিলো প্রবল জলে। মা বোঝার আগেই ফোনটা কেঁটে দিলাম।
প্রবাসে শত কষ্টের মাঝে থেকেও যখন আমরা শুনি প্রিয় মানুষেরা ভালো আছে, ভালো আছে প্রিয় দোহার, শত কষ্ট নিমিষেই যেন মলিন হয়ে যায়। আমরা আবার নতুন উদ্যমে আরেকটা নতুন কর্মদিবস শুরু করি। কিন্তু এই কোভিড নাইনটিন প্যান্ডেমিক শুরু হবার পর থেকে আমরা ভালো নেই। দোহারের প্রতিজন প্রবাসী ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করুন তাদের হৃদয়ে কতোটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতকিছুর পরেও আমরা আশার আলো খুঁজে পাই যেখানে, সেটা হচ্ছে আমাদের দোহারের প্রিয় যুবসমাজ।
ফেইসবুকে এত এত আর্তনাদ আর বিষন্নতার ফাঁকে যখন দেখি দোহারের যুবকেরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোনকে এই করোনা তান্ডবের হাত থেকে রক্ষা করতে, যখন দেখি আমার নদীপাড়ের সর্বহারা মানুষের পাশে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওরা খাবার নিয়ে দাঁড়ায়, যখন দেখি রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে ওরা বাজারে বাজারে গিয়ে মানুষকে সচেতন করবার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়, সত্যি তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। আমার অবর্তমানে আমার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য আমার এতজন ভাইকে যেই দোহারের মাটি জন্ম দিতে পারে, সেই দোহারের একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সবার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি দোহারের প্রিয় যুব-শক্তির কাছে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য৷
শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’টো কথা আউড়ে যাই-
আশার আলোকে
জ্বলুক প্রাণের তারা,
আগামী কালের
প্রদোষ-আঁধারে
ফেলুক কিরণধারা।
লেখক:
সোহাগ সকাল
দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী