শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রনেতা, বয়স মাত্র ২৮ বছর; বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি এগিয়ে নিতে সংগঠিত করছেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের। ওই সময়ই ঢাকায় পাকিস্তান পুলিশের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চে শেখ মুজিবের নামে খোলা হয় একটি ফাইল; সেটা ১৯৪৮ সালের কথা।
পরের ২৩ বছরে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে শেখ মুজিব পরিণত হন বাংলার অবিসংবাদিত নেতায়। আর তার নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের এগিয়ে চলে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরদারি ছিল পুরোটা সময়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর সেইসব গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সঙ্কলন প্রকাশিত হচ্ছে বই আকারে। শিরেনাম- ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
তারই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার গণভবনে এক অনুষ্ঠানে ১৪ খণ্ডের এই সঙ্কলনের প্রথম খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সঙ্কলনকে তিনি বর্ণনা করেন ‘অমূল্য তথ্যভাণ্ডার’ হিসেবে।
হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের প্রথম খণ্ডে ভাষা আন্দোলনের সূচনা, জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন, আওয়ামী লীগের জন্ম, শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠিপত্র, বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ, বক্তব্য-বিবৃতি, গ্রেপ্তার, কারাবরণ, কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন ও নেতাকর্মীদের সাক্ষাতের বিষয়গুলো উঠে এসেছে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের বয়ানে।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।
তাকে নিয়ে ইংরেজি ভাষায় পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের লেখা গোপন প্রতিবেদনগুলো দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) রেকর্ড রুমে পড়ে ছিল অযত্ন আর অবহেলায়।
বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী এসবি প্রধানের দায়িত্বে থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহে সেসব নথি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। ৬০৬-৪৮ ফাইল নম্বর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে যেসব ক্লাসিফায়েড প্রতিবেদন সেখানে ছিল, সেগুলোর পাঠোদ্ধার ও সঙ্কলিত করার ব্যবস্থা করেন।
‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে। ৫৮২ পৃষ্ঠার প্রথম খণ্ডের দাম রাখা হয়েছে ৯০০ টাকা। একই নকশায় প্রতিটি খণ্ডের প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে যেসব প্রতিবেদন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাত, স্বাভাবিকভাবেই তার সব হত তার বিরুদ্ধে।
এতবছর পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেইসব ‘বৈরী প্রতিবেদন’ কেন আওয়ামী লীগ সরকার প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে, প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তার ব্যাখ্যা দেন প্রধানমন্ত্রী।
তার ভাষায়, এসব প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা ‘অমূল্য’।
“কয়লা খনি খুড়ে হীরার খনি পাওয়া যায়। আমার মনে হয়েছে, ঠিক সেই ভাবেই যেন আমরা হীরার খনি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৪৮ সাল থেকে ৭১ পর্যন্ত জাতির পিতার প্রতিটি কর্মকাণ্ড ও গতিবিধির অনেক তথ্য এখানে আছে।… সবই তার বিরুদ্ধের রিপোর্ট। আর এই রিপোর্টের মধ্যে থেকেই কিন্তু আমরা সব থেকে মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করতে পারব।”
মাতৃভাষার আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে কারও কারও প্রশ্ন তোলার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এমন কথা বলা হয়েছে- ‘তিনি তো জেলে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে আবার কী করলেন?’ এই যে মানুষের একটা বৈরী চিন্তা ভাবনা.. আমি আশা করি, এই ডকুমেন্টগুলো পেলে পরে বাংলাদেশের জনগণ সত্যটা আবিষ্কার করতে পারবে।”
বাকি ১৩টি খণ্ড খুব দ্রুতই প্রকাশ করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রকাশনার মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের অনেক ঘটনার ‘আসল সত্য’ জানতে পারবে বলে তিনি আশা করছেন।
৪৬টি ফাইলের ৪০ হাজারের মত পৃষ্ঠা থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলোর পাঠোদ্ধার করে সঙ্কলিত করার কাজটি কতটা কঠিন ছিল, সে কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী।
২০০৯ সালে এসবির দায়িত্বে আসার পর তিনি স্পেশাল ব্রাঞ্চের যে ২২ কর্মকর্তাকে নিয়ে কঠিন এই কাজটি শেষ করেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছেন, “সরকারি এই ডকুমেন্ট যেভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল সেভাবেই রাখা হয়েছে। অনেক সময় বক্তৃতাগুলির নোট নিতে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভুল করেছেন, আবার বৃষ্টিতে মুছে গেছে। দীর্ঘ দিনের পুরাতন হওয়ার কারণে কিছু দলিলের অংশ বিশেষ নষ্ট হয়েছে।”
এসব প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর নাম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে লেখা হয়েছে। কখনো মুজিবুর রহমান খানও লেখা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু লিখিত আকারে দেওয়ার পাশাপাশিষ একটি অনুলিপিও দেওয়া হয়েছে এই বইটিতে।
১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্পেশাল ব্রাঞ্চের দায়িত্বে থাকা ডিআইজি সামসুদ্দিন খান ১৯৯৭ সালে প্রথম এই প্রতিবেদনগুলো সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন। বইয়ের মুখবন্ধে তাকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর চীন ভ্রমণের ওপর শিগগিরই একটি বই প্রকাশ করা হবে। এছাড়া ১৯৬০ সালে জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধুর যে খাতাটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, সেটি উদ্ধার করা হয়েছে এবং তার ওপর ভিত্তি করে আরেকটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রাফিক নভেল প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকেরও প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানি আমলের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সঙ্কলিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আয়োজিত এ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং হাক্কানী পাবলিশার্সের প্রকাশক গোলাম মোস্তফাও বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান; ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহেনা ও তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন নিকটাত্মীয়, স্পিকার শিরীন শারিমন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
এছাড়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও মশিউর রহমান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ আলী, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন দর্শক সারিতে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ও চার নির্বাচন কমিশনার, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ,অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
ঢাকায় বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বর্নিকাট, ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, দেশি-বিদেশি অতিথি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং নানা শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে।