অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয়, অচিন্তনীয়- যত রকম বিশেষণ আছে, সব দিয়েও হয়ত শেষ করা যাবে না। তবে এক কথায় অসাধ্যই সাধন করলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। মুশফিকুর রহীমের পর এবার দায় শোধ করলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও।
দুই বছর আগে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে (২০১৬ সালের ২৩ মার্চ) ভারতীয়দের বিপক্ষে নিশ্চিত জয়ের দোরগেড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের ভুলে নায়ক হবার সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহীমরা। এবার ভায়রা ভাই মুশফিকুর রহীমের মত মাহমুদউল্লাহও ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে ঠিক দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিলেন।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে ওঠার অঘোষিত সেমির যুদ্ধে আজ রাতে টাইগারদের জয়ের নায়ক মাহমুদউল্লাহ। শেষ ওভারে ১২ রান দরকার থাকা অবস্থায় বাঘের মত গর্জে উঠলো রিয়াদের ব্যাট। লঙ্কান পেসার উদানারার প্রথম দুই বলে বাউন্সারের সামনে মোস্তাফিজ ব্যাটে-বলে করতে না পেরে রান আউট হলেন মোস্তাফিজ।
তিন নম্বর বলে এসে স্ট্রাইক পেলেন রিয়াদ। ঠিক আগের পর্বে মুশফিকুর রহীম যেভাবে পয়েন্ট আর কভারের ওপর দিয়ে প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে রিয়াদও কভারের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকালেন। তিন বলে দরকার আট রানের। ঠিক এমন সমীকরণে পরের বলে ডিপ মিড উইকেটে ঠেলে ডাবলস।
দুই বলে ৬ রান দরকার। পুরো প্রেমাদাসায় পিনপতন নিস্তব্ধ। এ অবস্থায় উদানার ফুললেন্থ বলকে কব্জির মোচড়ে স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে তুলে মারলেন। আর লঙ্কান ১১ ফিল্ডার ও পুরো প্রেমাদাসার স্টেডিয়ামকে স্তব্ধ করে বল আছড়ে পড়লো গ্যালারিতে। এরই সাথে অবিস্মরণীয় জয় পেলো বাংলাদেশ।
১৮ বলে ৪৩ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে আরব্য রজনীর সিন্দাবাদের মত বিগ্বিজীয় বীর বেশে সাজঘরে ফিরলেন রিয়াদ।
দু’বছর আগে ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি আসরের বড় মঞ্চে নায়ক হবার সুযোগ এসেছিল তার সামনে। শেষ ওভারে ১১ রান দরকার থাকা অবস্থায় প্রথম বলে সিঙ্গেলস নিয়ে মুশফিকুর রহীমকে স্ট্রাইক দিয়েছিলেন রিয়াদ। পরের দুই বলে দুই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে জয়ের খুব কাছে গিয়ে ভুল করে বসেন মুশফিক।
তিন বলে দুই রান করতে গিয়ে সিঙ্গেলস-ডাবলসে না নিয়ে তুলে মারতে গিয়ে প্রথমে ওয়াইড ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মুশফিকুর রহীম। দুই বলে দুই রান দরকার থাকা অবস্থায় সিঙ্গেলসে না খেলে ছক্কা হাঁকিয়ে হিরো বনতে গিয়ে উল্টো খলনায়ক হয়ে যান রিয়াদও।
মুশফিকের আউটের পরের বলে ভুল পথে হেঁটে দলের বিপর্যয়ে ডেকে এনেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। পঞ্চম বলটি ছিল ফুল টস। ফিল্ডাররা লং অফ ও লং অন ও ডিপ মিড উইকেটের সীমানার ধারে। অনায়াসে সোজা ব্যাটে খেলে সিঙ্গেলস নিতে পারতেন রিয়াদ। তাতে ম্যাচ টাই হয়ে যেত; কিন্তু তা না করে ফুলটস ডেলিভারিকে ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে উল্টো ক্যাচ আউট হলেন তিনি।
কিন্তু দুই বছর পর সেই মার্চ মাসে এবার তিন বলে ১২ রান করে সত্যিকার বীর বনে গেলেন রিয়াদ। এবার আর সিঙ্গেলস-ডাবলস নয়, শেষ দুই বলে দরকার ছিল ছয় রানের, ঠিক এরকম স্নায়ুক্ষয়ী অবস্থায় অসীম সাহসে ছক্কা হাঁকিয়েই দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিলেন রিয়াদ।
একেই বলে দায় শোধের ম্যাচ। আজকের ম্যাচের সমীকরণ অনেক কঠিন ছিল তার সামনে। শেষ ওভারে ১২ রান দরকার, প্রথম দুই বলে কোন রানই আসেনি। উল্টো একজন রান আউট। সেটাই শেষ নয়। উদানার দু’দুটি বাউন্সার ব্যাটসম্যানের মাথার ওপর দিয়ে যাবার পরও আম্পায়ারা ওয়াইড না ডাকায় ক্ষোভে অধিনায়ক সাকিব দল নিয়ে রিয়াদকে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বলেন।
কয়েক মিনিট তা নিয়ে অতি নাটকীয় পরিস্থিতিতে চলে যায়। আস্পয়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অধিনায়ক সাকিব নিজে সীমানার একদম ধারে এসে মুখে ও হাত নেড়ে মাঠ থেকে বেড়িয়ে আসতে বলছিলেন রিয়াদকে। চরম উত্তেজক অবস্থায় বাংলাদেশ শিবির। এমন পরিস্থিতিতে নিজের স্নায়ু ঠিক রাখা খুব কঠিন।
কিন্তু এমন কঠিন ও প্রতিকুল অবস্থায়ও রিয়াদ ঠিক নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছেন। সাহসী যোদ্ধার মত এতটুকু সাহস ও আস্থা না হারিয়ে ঠিক কাজের কাজটি করে লঙ্কানদের স্তব্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে মাঠ ছাড়েন।