বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ (পর্ব-২)

770

পৃথিবীর বিখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনি মাস্কারনহাসের বিখ্যাত বই “ Bangladesh : Legacy of blood” যার শাব্দিক অর্থ হতে পারে “বাংলাদেশঃ রক্তের ঋণ”। এ ব্যাপারে এ্যান্থনি মাস্কারনহাস বলেন- “এই বইটি বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের দুঃখজনক ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে লিখিত। ঘটনার প্রধান নায়কদের সাথে আমার ব্যাক্তিগত জানাশুনা, নাটকীয় ঘটনা প্রবাহের সাথে জড়িতদের সাথে ১২০টি সাক্ষাৎকার এবং সরকারি দলিল-নথিপত্র সাপেক্ষে এর ভিত রচিত হয়েছে।

নিউজ ৩৯ শুধুমাত্র বইটি অনুবাদের অংশ তুলে ধরেছে তার অগণিত পাঠকের সামনে। কোন মন্তব্য বা উক্তির সাথে নিউজ ৩৯ এর কোন সম্পর্ক বা দায় নেই। নিউজ ৩৯ ধারাবাহিক ভাবে বইটির অনুবাদ প্রকাশ করবে। অনুবাদ করেছেন তারেক রাজীব।

ঐ রাতে কেউই ভাবতে পারেনি, কি ছিল ফারুকের মনে। উৎসবে তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের প্রাণখোলা। তিনি যে কাজে মনস্থির করে ফেলেছিলেন তাতে হয় তিনি ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবেন না হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে তার নাম অমোচনীয়ভাবে অক্ষয় করে রাখবেন। তার ভাষায় ‘আমি অনুষ্ঠান উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঐটিই হতে পারত আমার জীবনের শেষ অনুষ্ঠান।‘

অতিথিদের সবাই চলে গেলে পারিবারিক আলাপচারিতায় ফারুকের বাবা-মা, চট্টগ্রাম থেকে আগত ফরিদার মা,ফরিদার বড় বোন জোবাইদা, তার স্বামী মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ঢাকায় অবস্থিত ২য় আর্টিলারির অধিনায়ক কফি ও সামান্য নাস্তা নিয়ে মগ্ন হন।

হটাৎই ফারুক তার ভায়রা মেজর রশিদকে একদিকে সরিয়ে আনেন। তিনি রশিদকে জানান, ‘আমি ১৫ই তারিখে তাই ঘটাতে যাচ্ছি, আমি শুক্রবার সকালে জীবনেরতরে মুজিবকে সরিয়ে দিচ্ছি।’

রশিদ চমকে উঠলেন। সচকিত রশিদ খুব দ্রুত চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কেউতো আবার ফারুকের কথা শুনে ফেলে নি! হটাৎ যেন গোপন ষড়যন্তের মাসগুলো শুরু হল বাংলাদেশে। কিন্তু রশিদ প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে খুব আস্তে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি পাগল হয়েছে?’ ‘আমাদের তো কোন সাথী অফিসার নেই, নেই অস্ত্রশস্ত্র, আমরা কিভাবে তাহলে সফল হব?’

অন্য খবর  ইতিহাসের এই দিনে : ২০ জুন

তেজদ্দীপ্ত শানিত চোখে ফারুক অন্য মেজরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা আমার তৈরিই আছে, কেউ না এলেউ আমি একাই এগিয়ে যাবো। তুমি ইচ্ছে করলে সরে দাড়াতে পারো। তবে জেনে রাখো, আমি ব্যর্থ হলে শাসক চক্র তোমাকেও ফাঁসিতে লটকাবে।

এবারো রশিদ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হচ্ছিল তিনি ফারুকের কথাগুলো হজম করছিলেন। অবশেষে হালকা পাতলা গড়নের দিরঘাদেহী আর্টিলারির অধিনায়ক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে যদি করতে হয় তবে করো কিন্তু এ নিয়ে আমাদের আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।

শহরের অন্যপ্রান্তে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ীটি তখনো দেশবাসীর চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। এটিই শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যিনি স্থপতি। এ বাড়ির কেউই জানে না মেজর ফারুকের পরিকল্পনা সম্পর্কে। শেখ মুজিবর রহমানের ছোট বোনের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ৩২নম্বরের বাড়িতে দুই দিন আগে থেকেই আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত হয়েছিলেন। বিয়ে শেষ হলে বেগম মুজিব ভদ্রভাবে সবাইকে বিদায় দেন। তবুও কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়ে গিয়ে ছিলেন। তাদের মাঝে মুজিবের প্রিয় বোনের স্বামী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত উপস্থিত ছিলেন। তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রন,পানি সম্পদ,পশু সম্পদ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্তে ছিলেন। আরও একজন সেখানে ছিলেন, তিনি হলেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে আবুল হাসানাৎ আব্দুল্লাহ। তিনি তিন দিন পরে অলৌকিকভাবে পারিবারিক ধ্বংসযজ্ঞ হতে বেচে গিয়েছিলেন।

ঐ রাতে পারিবারিক বিষয়াদির সাথে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজ নিয়েও ভাবছিলেন। তিনি তার প্রানপ্রিয় বাংলাদেশ নিয়ে যে কোন কিছু ভাবার সময় পরিবারের সবাইকে কাছে ডেকে নিতেন। সেদিনের আলোচ্য বিষয় ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রন।

আবুল হাসানাৎ আব্দুল্লাহ সেদিনের স্মৄতিচারন করতে গিয়ে বলেন, মামা সেদিন শরৎকালীন বন্যার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তামাকের পাইপ থেকে আসা ধোঁয়ায় পুরো ঘর মুখরিত হয়ে উঠেছিল। তিনি বলতে লাগলেন, আমি তখন বেশ ছোট। ড্রেজার কোম্পানির বিদেশীদের সাথে নদীর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। হটাতই এসব ড্রেজার বার্জ বানিয়ে বার্মায় সরিয়ে নেয়া হল। আর সেগুলো ফিরে এলো না। আমরা যেখানে খেলতাম সেখানে এখন আর কোন নদী নেই- এখন শুধু চর আর চর। আর এ কারণেই প্রতি বছর আমরা বন্যার শিকার।

অন্য খবর  ইতিহাসের এই দিনে: ১ ডিসেম্বর

পরিবারের সবাইকে উদ্দেশ্যে তিনি বলে উঠলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই কিন্তু ড্রেজারগুলো আমরা হাতে পাচ্ছি। তোমরা দেখো আমি ঠিকই নদীগুলো আঁচড়িয়ে ঠিক করে দিবো। আমার বাকশাল ঠিকই তা পারবে।তারপর হঠাৎই এক অসাড় মানসিকতায় তিনি বলে উথলেন, দেশের জন্য আমি যা করেছি তা কেউই বুঝতে পারল না।

ঐটি ছিল শেখ মুজিবর রহমানের অমিয় বাণী। কিন্তু ততক্ষণে তিনি তার প্রিয় বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার তলিনীতে চলে এসেছেন। এটা ছিল এক অতিমাত্রায় প্রেম-বিদ্বষ সম্পর্ক যা কেবল এক অতিমাত্রায় আবেগী ও উদ্বেলিত জাতির পক্ষেই সম্ভব। তারা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দেবতুল্য মানব শেখ মুজিব তার জাতির সাথে একাত্ম হতে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, জনগণকে ভালবাসার মাঝেই আমার শক্তি নিহিত। আর দুর্বলতা হচ্ছে আমি তোমাদেরকে অতিমাত্রায় ভালবাসি।

সাড়ে তিন বছর আগেই বাংলাদেশের জন্ম থেকেই তিনি তদেরকে গুরুর মতো শাসন করতেন। তিনি অদম্য উৎসাহে কাজ শুরু করলেন আর মঙ্গল চিন্তায় সদিচ্ছায় তার সচিবালয় তৈরি করলেন। তিনি সত্যের সাথে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললেন। তার সরলতার আশ্রয় নিয়ে চারিপাশে জমতে লাগলো চাটুকারদের তোষামোদ। অনিবার্য কারণেই জনগনের জাদুরমত আসক্তির ভালবাসা ম্লান হয়ে এলো আর তোষামোদ পরিনত হল ভীষণ তিক্ততায়। তবে এসব সত্ত্বেও, শেখ মুজিব সব ঠিক করতে পারবেন বলে আশাবাদ করেছিলেন। বাংলদেশিদের কাছে তার অক্ষমতা ধারণাতীত বিষয় ছিল। কিন্তু আগস্টের ১৫ সব অসম্ভবকে সম্ভবের ইতিহাস সৃষ্টি করলো। আর্মির সাঁজোয়া বাহিনীর গাড়ি সামনে অগ্রসর হতে শুরু করলো। মেজররা দিপ্তপদে এগিয়ে চললো।

আপনার মতামত দিন