জটিল সমীকরণে এখন বিএনপির রাজনীতি। নেতাকর্মীদের আস্থা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সাংগঠনিক অবস্থান শক্ত করার কঠিন কাজও নেতাদের সামনে। অন্যদিকে সংসদে মুখর থেকে বিরোধীদল হিসেবে তৈরি করতে হবে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের স্পেস। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেয়ায় শূন্য হওয়া বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে। ২০ দলীয় জোটের শরিকদের গুরুত্ব দিয়েই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অটুট রাখতে হবে। সর্বোপরি দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ বের করতে হবে। ইতিবাচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে হঠাৎ ইউটার্ন করে সংসদে যোগ দিয়েছে বিএনপি।
নানামুখী আলোচনার মধ্যেও বিএনপির সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে।
বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিয়মিত সংগঠন গোছানোর দিকেই মনোযোগ দিয়েছে বিএনপি। সরকারের কঠিন মনোভাব, প্রশাসনের গ্রেপ্তার-হয়রানী, মামলা-হামলাসহ সার্বিক বৈরি পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মী। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের ওপর তারা আস্থা রেখেছেন। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির ৫জন এমপিকে নিয়ে জটিলতার মুখে পড়ে বিএনপি। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে সংসদে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও একজন তা অমান্য করে শপথ নেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্য এমপিদের শপথ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তটি সবাই মেনে নিলেও এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে দলের সর্বস্তরে। এর রেশ গিয়ে পড়ে ২০ দলীয় জোটে। এ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ধরে রাখতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দায়িত্ব দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দায়িত্ব পাওয়ার পর দুই নেতা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন রোববার।
দলের অন্য ৫ জন সংসদে গেলেও সংসদের বাইরে রয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মির্জা আলমগীর শপথ না নেয়ায় শূন্য ঘোষিত হয়েছে বগুড়া-৬ আসন। ইতিমধ্যে আগামী ১৬ই জুন সেখানে উপনির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এ আসনে ভোটগ্রহণ ১৬ই জুন। বিএনপি উপনির্বাচনে অংশ নেবে কিনা এমন একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহলে। বিএনপি সংসদে অংশ নেয়ায় এই উপনির্বাচনে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতাও তৈরি হয়েছে। বিএনপি অংশগ্রহণ করলে সেখানে কে প্রার্থী হবেন? গুঞ্জন তৈরি হয়েছে দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতাকে সেখানে প্রার্থী করা হতে পারে। এছাড়া সংসদে যোগ দেয়ায় একটি সংরক্ষিত আসন পাবে বিএনপি। এতদিন নির্বাচিতরা শপথ না নেয়ায় বিএনপির জন্য নির্ধারিত একটি নারী আসন এতদিন স্থগিত ছিল। সেখানে কাকে মনোনয়ন দেবে দল এ নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন।
২০ দলীয় জোট অটুট রেখেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল বিএনপি। এ নিয়ে প্রথম থেকেই অসন্তোষ ছিল ২০ দলে। জোটের শরিক দলগুলো নিজেদের গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করেছিল। শরিক দলের কিছু নেতা এ নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়ার পর সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল বিএনপি। ফ্রন্ট ও জোটের যৌথ সিদ্ধান্তে তারা অংশ নিয়েছিল একাদশ জাতীয় নির্বাচনে। নির্বাচনের পর ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে সংসদে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল যৌথ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একক সিদ্ধান্ত সংসদে গিয়েছে বিএনপি। এ শপথ ঘিরে ২০দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে চলছে অস্থিরতা। এরই জেরে দুই দশকের সম্পর্ক ভেঙে ২০ দল ছেড়েছে ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থর দল বিজেপি।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে না দিলে জোট ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছে আরেক শরিক দল লেবার পার্টি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন জোটের শরিকদের ক্ষোভ সারিয়ে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অটুট রাখার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে গুঞ্জন ছিল বিএনপি সংসদে যোগ দিলেই জামিনে মুক্তি পাবেন খালেদা জিয়া। সংসদে যোগ দেয়ার একটি অঘোষিত কারণ হিসেবেও প্রচার করা হচ্ছিল খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি। কিন্তু সংসদে যোগ দেয়ার দুই সপ্তাহ পরও তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে নতুন করে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে জামিন নয়, প্যারোলে মুক্তির পথেই হাঁটতে হবে। খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির দাবিতে বিএনপি নেতারা অটুট থাকলেও সায় নেই সরকারের। উল্টো আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলের মামলায় খালেদা জিয়ার জেল হলে দুদকের পাশাপাশি তার জামিন আবেদনের বিরোধীতা করেছে সরকার। হঠাৎ করে জামিন বিষয়ে সরকার অবস্থান পরিবর্তন করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বার্তা যাবে যে খালেদা জিয়াকে এতদিন জামিন না দেয়াটা সরকারের কারণেই হয়েছে।
ধীরে মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মাবে যে বিএনপির চেয়ারপারসনের জেল হওয়াটাও সরকারের ইচ্ছায় হয়েছে। এটা সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে। তাই জামিনে ছাড় দিতে রাজী নয় সরকার। জামিনের ব্যাপারে সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বিএনপি নেতাদের জানানো হয়েছে। তবে প্যারোলের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান নমনীয়। প্যারোলের আবেদন করলে সরকার কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, বরং ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে দেখবে। এদিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার যে কোন মূল্যে মুক্তি চায় দলটির নেতাকর্মীরা। দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলেছেন, আগামীদিনের পদক্ষেপ নিতে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সবদিক বিবেচনায় এক জটিল সমীকরণে রয়েছে বিএনপি।