স্মৃতির জানালায় প্রিয় শিক্ষক

2563

বার্ধক্যে উপনীত প্রিয় শিক্ষককে দেখতে তাঁর বাড়িতে গেলেন তাঁরই এক সময়কার কয়েকজন ছাত্র। বিছানায় নিশ্চুপ শুয়ে থাকা শিক্ষকের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন তাঁরা। বিনয়ের সাথে নিজেদের পরিচয় দিয়ে শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলেন তাদেরকে চিনতে পেরেছেন কি না। বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন শিক্ষক। অতঃপর ধীরলয়ে একটি ক্ষীণ কন্ঠ ভেসে এলো ছাত্রদের কানে। কিছুটা জড়তা মাখা, খানিকটা অস্পষ্ট সেই কন্ঠটি জানান দিল স্মৃতির মহাসাগরের তলদেশ থেকে মুহূর্তেই যেন খুঁজে পেলেন শিক্ষক তাঁর প্রিয় ছাত্রদের। তবে যে কন্ঠে একসময় ক্যাম্পাসের চারিদিকের বাতাস প্রকম্পিত হতো, আজ সে কন্ঠ কতোটা যে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে! যে দুরন্ত গতির পায়ের ভারে মাঠের সবুজ ঘাসগুলো নুয়ে পড়তো, আজ সে পা দু’টো যেন আর যেতেই চায়না ঘরের চার দেয়ালের বাইরে। শরীরটা যেন বিছানাকেই এখন ঠাঁই করে নিয়েছে অনেকটা স্থায়ী ভাবে। নিরন্তর বয়ে চলা জীবন ঘড়ির কাটাটি কত নির্দয়, কত নির্মম!

আমার কল্পনায় দেখা তবে হয়তো অনেকটাই বাস্তব এমন একটি ছবির অবয়ব আমার হৃদয় গহীণে আজ যেন ঘোর পাক খাচ্ছে ।

জয়পাড়া পাইলট হাইস্কুলের বার্ধক্যে উপনীত প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী মিয়া স্যারকে দেখতে গিয়ে কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লায়ন সালাম চৌধুরী ভাই। যদিও আমি হায়াত আলী মিয়া স্যারের স্কুলের ছাত্র ছিলাম না কিন্তু স্যারের বার্ধক্য জনিত বর্তমান শারীরিক অবস্থাটি জেনে সেদিন আমার মনটা কেমন যেন বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো।

আমার মনের আয়নার ভেসে এলো জীবন সিঁড়ির প্রথম অংশের একটি ধাপে স্যারের সাথে আমার ক্ষণিকের কিছু স্মৃতিময় মুহূর্ত। আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগের সেই স্মৃতিটি আমাকে অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়। হৃদয়ের জানালায় উঁকি দেয়া সেই স্মৃতি আমাকে শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী স্যারের খুব কাছে টানে, তার আঙ্গিনায় নিয়ে চলে আমাকে। যদিও সেই ক্ষণিক দেখার আগে বা পরে আর কখনো স্যারের সাথে আমার সরাসরি দেখা বা কথা হয়নি।

মুকসুদপুর শামসুউদ্দিন শিকদার উচ্চ বিদ্যালয় (ঐ সময় মুকসুদপুর উচ্চ বিদ্যালয়) হতে এস এস সি ১৯৮৩ ব্যাচের পরীক্ষা দিতে জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলাম। বিজ্ঞান বিভাগের প্র্যাকটিক্যাল অংশের ভাইবা পরীক্ষার প্রাক্কালে আমাদের স্কুলের শ্রদ্ধাভাজন তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুস সামাদ স্যার শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী স্যারের (সম্ভবত কেন্দ্র সচিব ছিলেন) সাথে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এলেন। বিশেষ করে আমাকে ফার্স্ট বয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ ভাইবা বোর্ডে হায়াত আলী স্যার আমার গ্রামের নাম, পিতার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি পিতার নামের আগে জনাব বলাতে তিঁনি খুশি হলেন এবং জনাব বলি কিনা তা যাচাই করতেই পিতার নাম জিজ্ঞেস করেছেন বলে জানালেন। আমার গ্রামের নাম মধুরখোলা শুনে তিনি কিছুটা রসিকতার স্বরে জানতে চাইলেন আমার গ্রামে অনেক মধু পাওয়া যায় কিনা।তখন কি বলেছিলাম তা আজ আর পরিষ্কার মনে নেই। তবে কিছুদিন আগে “আমার গ্রাম” কবিতায় সেই প্রশ্নের আমি একটি উত্তর রেখেছি । উদ্ভিদ কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তরে “ যাহা মাটি ভেদ করে উঠে তাকে উদ্ভিদ বলে এমন উত্তর শুনে তিঁনি বল্লেন, ”তাহলে তো ওরচুঙ্গাও উদ্ভিদ।“ সাথে সাথে আমি বল্লাম, “স্যার, যাহা মাটি ভেদ করে উঠে এবং স্থান ত্যাগ করতে পারেনা তাকে উদ্ভিদ বলে।“ স্যার এবার হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন “ তোমার থেকে আমি ক’জনের পরে বসে আছি। আমি গুনে দেখে বল্লাম ৫ জনের পরে। স্যার প্রশ্ন করলেন পাঁচ এবং পঞ্চম এর মধ্যে তফাত কি? আমি বল্লাম পাঁচ বলতে পাঁচটি সংখ্যাকে বুঝায় আর পঞ্চম বলতে প্রথম চারটি সংখ্যা বাদ দিয়ে পরবর্তী সংখ্যাটিকে বুঝায় ।আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর শুনে স্যার বেশ খুশি হলেন এবং প্রশংসা করলেন। পরীক্ষার ফলাফলেও তার প্রতিফলন পেলাম।

অন্য খবর  ঢাকায় ৪.৩ মাত্রার ভূকম্পন উৎপত্তিস্থল দোহার

প্রায় ৩ যুগ আগের ভাইবা পরীক্ষার সেই দিনটি থেকে শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী মিয়া স্যারের নামটি আমার অজান্তেই মনের ডায়েরিতে স্থায়ী ভাবে লেখা হয়ে যায়। স্যারের সুন্দর মুখশ্রী সেদিন আমার হৃদয়পটে কোন এক অজানা শিল্পী যেন রংতুলিতে এঁকে দিয়ে গেলেন । শ্রদ্ধেয় স্যারদের মূল্যায়ন করার মতো স্পর্ধা আমি রাখি না বা সে জ্ঞানও আমার নেই। তবে প্রসংগক্রমে দু-একটি কথা বলছি।

আমাদের সময়ে দোহারের হাই স্কুলগুলোর গুণী সেরা শিক্ষকদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী মিয়া স্যারের অসম্ভব নাম ডাক ছিলো। তিঁনি অনেক বড় মাপের একজন শিক্ষাগুরু।

সমসাময়িক সময়ে গুণী সেরা শিক্ষকদের আরেক জন যিনি তাঁর ছাত্র হিসেবে আমাকে সেদিন শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী মিয়া স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, মুকসুদপুর শামসুদ্দিন শিকদার উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আমার সরাসরি শিক্ষাগুরু প্রয়াত শ্রদ্ধেয় আব্দুস সামাদ স্যার। তিঁনি ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর ভবের মায়া ছিন্ন করে বিধাতার ডাকে পরপারে পাড়ি জমান।

শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী মিয়া স্যার, প্রয়াত আব্দুস সামাদ স্যারদের বাইরেও বেশ ক’জন গুণী আদর্শ শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি আমি।তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুকসুদপুর শামসুউদ্দিন শিকদার উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত আব্দুর রহমান স্যার, কাঞ্চন স্যার, নারায়ন স্যার,অশোক স্যার,আহমদ আলী স্যার (পরবর্তীতে নারিশা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন) প্রমুখ। সেই সময়ে এই তালিকায় প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে মধুর খোলা প্রাইমারীর জব্বার স্যার, মুকসুদপুর প্রাইমারীর প্রফুল্ল স্যার, মইৎপাড়া প্রাইমারীর রইস উদ্দিন স্যার, সাতভিটা প্রাইমারীর শফিউদ্দিন স্যার,নারিশা পশ্চিমচর প্রাইমারীর তালিম স্যার সহ আরো অনেক অনেক গুণী শিক্ষকের নাম বলা যায়। যাঁদের অনেকেরই সান্নিধ্য পেয়েছি আমি।

দোহারের সেই সময়কার সেরা শিক্ষকদের অনেকেই আজ বিধাতার ডাকে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।মহান সৃষ্টি কর্তার দরবারে তাঁদের সকলের আত্মার শান্তি কামনা করছি। বেঁচে থাকাদের মধ্যে এখন অনেকেই জীবনের চরম সত্য বার্ধক্যে উপনীত। শ্রদ্ধেয় হায়াত আলী স্যারের মতো অনেকেরই দেহটা হয়তো এখন আর বিছানা থেকে উঠতে চায় না!

অন্য খবর  গাড়ির ধাক্কায় ভেঙ্গে পড়েছে দোহার উপজেলা সীমানা প্রাচীর

আমার কিশোর বয়সে দেখা ভীষণ প্রাণবন্ত,সূর্যের ন্যায় তেজোদীপ্ত,আকাশের ন্যায় উদার, পান্ডিত্বে ভরপুর অসামান্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষাগুরুদের শরীরে আজ বহমান নদীর সেই স্রোত আর নেই। জীবন পথের কোন এক বাঁকে বার্ধক্য এসে চিরচেনা পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। থমকে গেছে তাঁদের একসময়ের দীপ্ত পায়ে অপ্রতিরুদ্ধ পথচলা। পিছনে ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর অনেক স্মৃতিই যেন বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে বা ধূসর মরুর বুকে দৃষ্টির শেষ সীমান্ত রেখায় আলো আঁধারের মাঝে আজ অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আসলে এরই নাম জীবন ঘড়ি।যারা একসময় শ্রেণী কক্ষে ছাত্রদের শুনাতেন “সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।” সেই চিরন্তন বাণীর ধ্বনি যেন বিদ্যালয়ের দেয়ালে আজ প্রতিধ্বনিত হয়ে নিরালায় নিজ ঘরের বিছানায় নিশ্চুপ শুয়ে থাকা সেই মহান শিক্ষকদের নিজ কানে এসে বাজছে।

সময়ের স্রোত আর জীবনের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততায় কখন যেন অনেক দূরের স্মৃতি হয়ে যায় আমাদের শৈশব কৈশোর। সেই স্মৃতির অপরিহার্য অংশ আমাদের স্কুল জীবন আর প্রিয় শিক্ষকগণ। যখন মনের আনন্দে উপভোগ করেছি দূরন্ত সোনালী শৈশব কৈশোর, তখন পরম যত্নে আমাদের জীবন ও মনন গড়নে ব্যস্ত ছিলেন আমাদের শিক্ষকগণেরা। কোন লোভ লালসা তাঁদের মোহাবিষ্ট করতে পারেনি। আদর্শ থেকে একচুলও পিছপা হননি। কেবলই টাকা ওয়ালা ক্ষমতা কেন্দ্রিক লোকদের কাছে টানেননি কোনদিন। ছাত্রদের সামনে তাঁরা হাজির করতেন এলাকার সত্যিকার গুণীজনদের।পাশে বসাতেন কর্মক্ষেত্রে সফল স্কুলের প্রাক্তন আদর্শ ছাত্রদের। যাতে ছাত্ররা তাদের দেখে লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহিত হয়। সত্যিকার মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার বাসনা তীব্র হয় মনে। পদ পদবীর উদ্দেশ্যে স্কুলের জন্য কারো কারো দানের আগ্রহকেও প্রত্যাখান করেছেন বিনয়ের সাথে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বাহ্যিক চাকচিক্যের চাইতে তাঁরা ছাত্রদের প্রতিভা বিকশিত করতে,তাদের জ্ঞানের রাজ্য সম্প্রসারণে, তাদের অন্তরাত্মাকে আলোকিত করতে সদা সচেষ্ট থাকতেন। অন্যায্য চাওয়া পাওয়ার আকাংকা, হীনমন্যতা তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি।

সেকারণেই তাঁরা কেবল শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। ছিলেন দার্শনিক, বাতিঘর, গাইড, রোলমডেল। আজকের ক্ষয়িষ্ণু সমাজে সেই আদর্শবান শিক্ষকদের বড় প্রয়োজন। মানবিক মূল্যবোধ বিবর্জিত অসুস্থ প্রতিযোগিতার অশুভ কালো থাবার করাল গ্রাস থেকে ছাত্র ছাত্রী তথা দেশ মাতৃকার আগামী দিনের চালকদের রক্ষা করতে আজ সাহসী, গুণী, আদর্শ শিক্ষকের বিকল্প নেই।

জ্ঞান নির্ভর আলোকিত সমাজ ও জাতি বিনির্মানে ভীষণ প্রয়োজন হায়াত আলী স্যার, আব্দুস সামাদ স্যার, আব্দুর রহমান স্যারদের মতো সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর।

আমার এ লেখায় কোন ভুলভ্রান্তি থাকলে সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরিশেষে জাতীর মেরুদণ্ড নবীন প্রবীন সকল শিক্ষকগণের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা, অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।

লেখক: শেখ তোফাজ্জল হোসেন সমঝদার
জেনারেল ম্যানেজার
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি

আপনার মতামত দিন