সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ার আশা বিশেষজ্ঞদের

432
সুন্দরবনে বাঘ

যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় বেশি মনোযোগী সরকার। তাই সুন্দরবন সংলগ্ন জেলার মানুষকে সচেতন ও বাঘ রক্ষায় সম্পৃক্ত করতে দুই বছর ধরে ঢাকার বাইরে জাতীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে ‘বাঘ দিবস’। ২৯ জুলাই রবিবার ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’। বাগেরহাটের পর এ বছর খুলনাতেও দিবসটি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে–‘বাঘ বাঁচাই, বাঁচাই বন, রক্ষা করি সুন্দরবন’।

বিশেষজ্ঞ ও বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবন। কয়েক বছর আগেও চোরাশিকারিচক্র এবং জলদস্যু-বনদস্যুদের তৎপরতার কারণে সুন্দরবনে বাঘ হুমকির মুখে ছিল। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপে সুন্দরবনে দস্যুতা এবং চোরাশিকারিদের তৎপরতা কমেছে। এ কারণে সুন্দরবনে আগের তুলনায় বাঘ অনেকটা সুরক্ষিত এবং বাঘের বিচরণক্ষেত্রও নিরাপদ বলে মনে করছে বন বিভাগ। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের দস্যুরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যেকোনো সময়ের চেয়ে সুন্দরবনে দস্যুতা কমে গেছে। বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে সুন্দরবনে চোরাশিকারিদের তৎপরতা নেই বললেই চলে। ফলে সুন্দরবনে বাঘ অনেকটা সুরক্ষিত। গত দুই বছরে সুন্দরবনে শিকারিদের হাতে কোনো বাঘ হত্যার খবর পাওয়া যায়নি।

বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. জাহিদুল কবির জানান, কিছুদিন আগেও বিশ্বের ১৩টি দেশে বাঘ ছিল। কম্বোডিয়ায় বাঘ শূন্য হওয়ার কারণে এখন বাংলাদেশসহ ১২টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব টিকে আছে। সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘের জন্য যে সব ঝুঁকি আছে, তা নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, ‘বাঘ শিকার রোধে মনিটরিং করা হচ্ছে। সুন্দরবনে বাঘ শিকার বন্ধ রয়েছে। এই অবস্থা ধরে রাখতে পারলে সিডর বা আইলার মতো প্রাকৃতিক এবং পরিবেশগত কোনো বিপর্যয় না ঘটলে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়বে।’

বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে সুন্দরবনে বাঘ টিকে আছে। সারা পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে গেলেও নিরপত্তা অটুট থাকলে সুন্দরবন থেকে বাঘ হারানোর সম্ভাবনা কম।

বিশ্বের বনাঞ্চল থেকে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে কমে মাত্র চার হাজারের নিচে দাঁড়িয়েছে। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির তিনটি ইতোমধ্যে বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

অন্য খবর  আতঙ্কিত গ্রামবাসীর হাতেই মারা পড়লো বিরল বাগডাশ, দায় কার?

বন বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়ায় বাঘের অস্তিত্ব টিকে আছে। ভিয়েতনাম ও লাওসে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বাঘ। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনিজ টাইগার, জাভানিজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার বিশ্ব হতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে পাঁচটি উপ-প্রজাতি টিকে আছে। সেগুলো হচ্ছে–বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান টাইগার, সুমাত্রান টাইগার, সাউথ চায়না টাইগার এবং ইন্দো-চায়না টাইগার।

ওয়াইল্ড টিমের প্রধান নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম জানান, সারা পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে গেলেও সুন্দরবন থেকে বাঘ হারানোর সম্ভাবনা কম। নদ-নদী বেষ্টিত সুন্দরবন। বাঘ না বাঁচলে সুন্দরবন টিকবে না। সুন্দরবন মায়ের মতো। বাঘের সঙ্গে দেশের সুনাম জড়িয়ে রয়েছে।

আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বাঘের খাবার টিকিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সুন্দরবনে হরিণ সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার কথাও ভাবতে হবে। বনের মধ্যে মানুষের বিচরণ কমাতে হবে। পর্যটকদের জন্য বনকেন্দ্রিক তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে।’

অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘পূর্ণবয়ষ্ক বাঘিনী বছরে তিন থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। বাঘের ওই বাচ্চা রক্ষা করা গেলে অবশ্যই সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বাঘ রক্ষায় সকলকে সম্পৃক্ত করতে হবে।’

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান জানান, প্রথম বার (২০১৩-২০১৫ সালে ) সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের জন্য পাঁচ বর্গ কিলোমিটার পরপর ক্যামেরা স্থাপন করে চিত্রধারণ করা হয়েছিল। এবার (২০১৭ ও ২০১৮ সালে) প্রতি দুই বর্গ কিলোমিটার পরপর ক্যামেরা স্থাপন করে চিত্রধারণ করা হয়েছে। ধারণকৃত ওই চিত্র এখন ঢাকায় সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশেও সে দেশ ক্যামেরা ট্রাপিং করেছে। বিশ্লেষণ শেষে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের গোটা সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা জানা যাবে।

সূত্র জানায়, ২০১৩-২০১৫ সালে সুন্দরবনে প্রথম পরিচালিত ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের’ মাধ্যমে জরিপ অনুসারে সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে তখন বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছে ১০৬টি।

অন্য খবর  ৫০ টাকায় করানো যাবে ডেঙ্গু পরীক্ষা

সুন্দরবনের মোট আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনে প্রতিটি বাঘ তাদের আবাসস্থলের জন্য ১৪ থেকে ১৬ বর্গ কিলোমিটার (হোমরেঞ্জ) চিহ্নিত করে সেখানে বাস করে। আর গোটা সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করে থাকে। বলা হয়, বাঘ সুন্দরবনের ফ্লাগশিপ ইস্পশিজ হিসেবে কাজ করছে। সুন্দরবনে জলদস্যু-বনদস্যু ও চোরাশিকারিদের তৎপরতা কম শুধু বাঘের কারণে। বাঘ না থাকলে সুন্দরবনও হুমকির মধ্যে পড়বে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির কারণে লবণাক্ততা, ঝড়-জলোচ্ছাস ও নদীর স্রোত প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করছে বাঘ। নদী-খাল ভরাট হওয়ার কারণে বাঘ মাঝে-মধ্যে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।

সরকার ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে। নতুন আইন অনুযায়ী, বাঘ হত্যা ও পাচার করলে প্রথমবারের জন্য দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বাঘ হত্যা বা পাচার করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও ১৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আবার বন বিভাগ থেকে পাস নিয়ে সুন্দরবন থেকে বনজসম্পদ আহরণ করতে গিয়ে কেউ বাঘের হামলায় নিহত বা আহত হলে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সরকার।

সুন্দরবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি এবং বাগেরহাটের সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বলেন, ‘সুন্দরবন ঘেঁষা কয়েকটি গ্রামে একসময় একাধিক বাঘ শিকারি চক্র সক্রিয় ছিল। কয়েক বছর আগেও শিকারি চক্র ও দস্যুরা গুলি করে, বিষটোপ দিয়ে এবং ফাঁদ পেতে বাঘ হত্যা করেছে। এখন ওই সব গ্রামে আর শিকারি চক্রের তৎপরতা নেই।’

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। সুন্দরবন ও বনের সম্পদ সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। সুন্দরবনকে মানুষ ভালোবাসতে শিখেছে। সর্বোপরি সুন্দরবন সংলগ্ন অনেক মানুষ কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়ায় বনে প্রবেশের প্রবণতা কমে গেছে। এসব কারণে এখন সুন্দরবনে বাঘ হত্যা নেই বললেই চলে।’

আপনার মতামত দিন