রোহিঙ্গা বিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধে ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি দিলো ফেসবুক

93
রোহিঙ্গা বিদ্বেষী

ফেসবুকের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিধনে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বহু আগেই। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা সেইসব অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে জনপ্রিয় ওই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপের অঙ্গীকার করেছিল তারা। তবে এক মার্কিন মানবাধিকার সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, ফেসবুক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বিদ্বেষী প্রচারণা এখনও চলছে, তা থামানো যায়নি। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগও স্বীকার করে নিয়েছে। তারা মেনে নিয়েছে, বিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধ করা তাদের দায়িত্বের অন্তর্গত। তবে এ ব্যাপারে তারা কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, অতীতের মতো এবারও তা স্পষ্ট করে বলেনি তারা।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার। তাদের ‘বাঙালি মুসলমান’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের বাসিন্দা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় নেপিদো। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর দেশটির বাসিন্দা হিসেবে রোহিঙ্গাদের যে সবুজ ও গোলাপি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল, তা গুরুত্বহীন হয়ে যায় ৮২ সালের নতুন নাগরিকত্ব আইনে। মিয়ানমারের ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ১৯৮২ সালে তৎকালীন সামরিক জান্তা সরকার নৃগোষ্ঠীভিত্তিক নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করে। বিতর্কিত ওই বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইনে মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। বস্তুত এই আইনটিই জান্তাশাসিত মিয়ানমারে সর্বোচ্চ সেনাবিদ্বেষের শিকার রোহিঙ্গাদের ভাসমান জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর করে। সেখানে যুগের পর যুগ ধরে বিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ঘৃণা উৎপাদনে ফেসবুকের ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও অক্টোবর ২০১৭ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সব পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই রোহিঙ্গাবিদ্বেষী প্রচারণার মধ্য দিয়ে পরিকল্পিত সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। সে সময় অ্যামনেস্টির এক প্রতিবেদনেও ‘রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সামরিক প্রচারণা’কে সেখানকার সংকটের জন্য দায়ী করা হয়। চলতি বছর মার্চে জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধান মিশনের চেয়ারম্যান মারজুকি দারুসমান সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা নিধনে সামাজিক মাধ্যম ‘নির্ধারণী ভূমিকা’ পালন করেছে। এপ্রিলে দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, রাখাইন সংকটে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাযুক্ত বক্তব্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে নির্ধারণী ভূমিকা ছিল ফেসবুকের। আগস্টে রয়টার্সের অনুসন্ধানেও রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের নেপথ্যের ঘৃণাবাদী প্রচারণা ঠেকাতে ফেসবুকের ব্যর্থতার কথা উঠে আসে। অক্টোবরে নিজস্ব অনুসন্ধান সূত্রে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনীর নিয়োজিত কর্মীরা ফেসবুক ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে।এবার এক মার্কিন মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখনও ফেসবুক ব্যবহার করে মিয়ামারে বিদ্বেষী প্রচারণা চলছে।

অন্য খবর  প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের পর খুলছে ফেসবুক

মিয়ানমারে ফেসবুকের প্রায় ২ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা বিএসআর তাদের প্রতিবেদনে অভিযোগ তুলেছে, ফেসবুক মিয়ানমারের জনগণকে ঘৃণা এবং সহিংসতা ছড়ানোর জন্য তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে দিচ্ছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার আল-জাজিরার খবরে বিজনেস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি-বিএসআর নামের মানবাধিকার সংস্থাকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে, ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো বন্ধে ফেসবুক কার্যকর কোন ভূমিকা রাখছে না। সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক ওই সংস্থা সতর্ক করেছে, সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি মিয়ানমারে অপ্রতিরোধ্য সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। তারা বলছে, স্থানীয়ভাবে যারা ফেসবুকের হয়ে কাজ করছেন, তারা হয়তো কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে কাজ করতে সক্ষম। তবে সেক্ষেত্রে তাদের সেনাবাহিনীর তোপের মুখে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে কাজটি সহজ নয়।

বিজনেস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি আরো বলছে, ফেসবুকের উচিত ২০২০ সালের মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভুল তথ্য ছড়ানো এবং হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মাধ্যমে যে নতুন সমস্যাগুলো হচ্ছে সেগুলো ঠেকাতে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া ।

চলতি বছরের এপ্রিলেই মিয়ানমারে জাতিগত নিধনে ফেসবুকের ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভক্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে সময় বলেন, খবরের নামে গুজব ছড়ানোর মধ্য দিয়ে মুসলিম ও রোহিঙ্গাবিদ্বেষী মনোভাবে উসকানি ও প্রণোদনা জোগানোর কাজে ফেসবুককে ব্যবহার করা হয়েছে। গত আগস্টে ফেসবুক কর্তৃপখ।স স্বীকারোক্তি দেয়, রোহিঙ্গা বিদ্বেষী ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রতিরোধ এবং ঘৃণা ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত সদস্যদের আইডি নিষিদ্ধ করায় তাদের ভূমিকা খুবই ধীর ছিল। এবার নতুন করে ওঠা বিএসআর-এর অভিযোগ প্রসঙ্গে ফেসবুকের প্রোডাক্ট পলিসি ম্যানেজার আলেক্স ওয়ারোফকা একটি ব্লগে বলেন, ওই প্রতিবেদনটি এই বছরকে প্রাধান্য দিয়ে করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে আমাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মিয়ানমারে যে জাতিগত বিভেদ এবং সহিংসতা ছড়ানো হচ্ছে তা প্রতিরোধে আমাদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।আমরা স্বীকার করছি যে এ নিয়ে আমরা আরও বেশি কিছু করতে পারি এবং আমাদের তাই করা উচিত।

অন্য খবর  ভেবে-চিন্তে ফেসবুকে!

বিজনেস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি তাদের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে এমন সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। ফেসবুকের কন্টেন্ট পলিসি আরো কঠোর করা, সরকার আর নাগরিক সমাজের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো, দেশটিতে ফেসবুকের কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়ে থাকা অতিরিক্ত তথ্য প্রকাশের সুপারিশ করেছে তারা। এদিকে ফেসবুক দাবি করেছে, প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়বস্তু পর্যালোচনার জন্য মিয়ানমারের ভাষার ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞানসম্পন্ন ৯৯ জন ভাষাবিদ তাদের সঙ্গে রয়েছেন। তারা জানিয়েছে, এরইমধ্যে মানবতাবিরোধী ও সহিংস বিষয়বস্তু প্রতিরোধে তাদের স্বনিয়ন্ত্রিত টুলস-এর কার্যসীমা বাড়ানো হয়েছে।

আপনার মতামত দিন